সিডরে নিখোঁজ শহিদুল: বাড়ি ফিরলেন ১১ বছর পর!

ঘূর্ণিঝড় সিডরে সাগরে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ হওয়ার ১১ বছর পর জেলে শহিদুল মোল্লা (৪৮) বাড়িতে ফিরেছেন। এত বছর পর প্রিয়জনদের কাছে পেয়ে স্বজনরাও খুশিতে আত্মহারা, হতবাক। পরিবারের সদস্যরা জানান, শহিদুলের বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন বহু আগেই।

জানা গেছে, শহিদুলের বাড়ি বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলার খোন্তাকাটা ইউনিয়নের দক্ষিণ আমড়াগাছিয়া গ্রাম। ওই গ্রামের ফুলমিয়া মোল্লার ছেলে তিনি। ঘূর্ণিঝড় সিডরে সরকারিভাবে নিখোঁজের তালিকায় নাম রয়েছে শহিদুলের। পরিবারের সদস্যরা জানান, শহিদুল বাড়ি ফিরলেও অনেকটা মানসিক ভারসাম্যহীন। কথাবার্তায় এলোমেলো ভাব রয়েছে।

জানা গেছে, ছোট ভগ্নিপতি পান্না ফরাজীর নৌকা নিয়ে শহিদুল মাছ ধরতে গিয়েছিল সাগরে। ওই নৌকায় শহিদুলের সঙ্গি মাসুম ছিদ্দিক এবং সেলিম ছিল। আর মৎস্য ব্যবসায়ী ইউনুচ শিকদারের নৌকায় ছিলেন শহিদুলের বাবা ফুলমিয়া মোল্লা। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে সিডরে জলোচ্ছাসে ভেসে তারা সবাই নিখোঁজ হয়। সিডরের ১১ বছর পর শহিদুল বাড়িতে ফিরে এলেও তার বাবাসহ অপর দুজন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।

রবিবার দুপুরে শরলণখোলা উপজেলার রায়েন্দা বাজারে ভগ্নিপতি পান্না ফরাজীর বাড়িতে থাকা মানসিক ভারসাম্যহীন শহিদুলের সঙ্গে কথা হয় স্থানীয় সাংবাদিকদের। এ সময় শহিদুল কথা এলোমেলো বলছিলেন। সিডর কি তা তার স্মরণে নেই। এখন যা বলছে, একটু পর সেকথা আর মনে করতে পারছেন না তিনি। সিডরে কোথায় ছিল, কি ঘটেছিল তাও বলতে পারছে না। তবুও তার অসংলগ্ন কথায় যা জানা গেল, ভারতের পাটগ্রাম নামক এলাকায় রশিদ খানের বাড়িতে থাকত সে। সেখানে গরু রাখা আর বাড়ির কাজবাজ করত। এরপর সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। সীমান্তে তাকে কেউ আটকায়নি। এসবও তার ভারসাম্যহীন মনের কথা। সঠিক করে বলতে পারছে শুধু নিজের নামটাই।

শহিদুলের বড় বোন মঞ্জু বেগম ইউএনবিকে বলেন, স্থানীয় আমড়াগাছিয়া বাজারে শহিদুল নামে এক পাগল ঘোরাফেরা করছে এমন খবর পাওয়ার পর সে ১২ নভেম্বর বাজারে ছুটে যায়। গিয়ে দেখেন বাসস্ট্যান্ড যাত্রী ছাউনিতে ঘুমিয়ে আছে শহিদুল। তার কপালের বামপাশে কাটা দাগ, হাতের আঙ্গুলে বড়সি ঢুকে ক্ষত হয়েছিল, এসবের মিল দেখেই সনাক্ত করেন ভাইকে। সেখান থেকে উদ্ধার করে বাড়িতে এনে তার পাগলবেশে থাকা লম্বা চুল, দাঁড়ি কেটে সিডরে হারিয়ে যাওয়া শহিদুলকে আবিষ্কার করেন। শহিদুল মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছেন।

শহিদুলের ভগ্নিপতি পান্না ফরাজী ইউএনবিকে জানান, শহিদুলের দুই মেয়ে এবং দুই ছেলে। বড় মেয়ে পুতুল (২০) এবং মুকুলের (১৮) বিয়ে দিয়েছেন তারা। ছেলে মাসুম (১৭) মাদ্রাসায় হাফেজি পড়ছেন। ছোট ছেলে মাসুদ (১১) সিডরের সময় তার মায়ের গর্ভে ছিলেন। সিডরে স্বামী শহিদুলকে হারিয়ে কষ্টে দিন চলছিল মাসুমা বেগমের। দীর্ঘদিনেও নিখোঁজ স্বামীর সন্ধান না পাওয়া গত কয়েক বছর আগে মাসুমা নতুন করে সংসার পেতেছেন। বর্তমানে সে কাজের সন্ধানে ভারতের বেঙ্গালুর শহরে অবস্থান করছে বলে পান্না ফরাজী জানান।

পান্না ফরাজী আরো জানান, শহিদুলের ফিরে আসার খবর মাসুমাকে জানানো হয়েছে। সে উচ্ছ্বসিত এবং আনন্দিত। মাসুমা শিগগিরই শরণখোলায় ফিরে আসবে বলে তিনি জানান।

খোন্তাকাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন খান মহিউদ্দিন ইউএনবিকে জানান, কিছুদিন ধরে স্থানীয় লোকজন পাগলবেশে শহিদুলকে আমড়াগাছিয়া বাজারে ঘোরাফেরা করতে দেখে। তার পরিবারের লোকজন শরীরের বিভিন্ন স্থানে চিহৃ দেখে শহিদুলকে সনাক্ত করে বাড়িতে নিয়ে গেছে। সিডরের রাতে শহিদুল এবং তার বাবাসহ আরও বেশ ককেয়জন নিখোঁজ হয়। শহিদুলকে ১১ বছর পর পাওয়া গেলেও অন্যদের খোঁজ আজও মেলেনি।

শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লিংকন বিশ্বাস ইউএনবিকে জানান, সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে সিডরে জলোচ্ছাসে নিখোঁজের তালিকায় শহিদুল মোল্লার নাম রয়েছে। ১১ বছর পর শহিদুল বাড়িতে ফিরে আসা আনন্দের সংবাদ। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে খোঁজখবর নিয়ে তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে স্বরণকালের ভয়াবহ সিডরের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যায় বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী ও ঝালকাঠি জেলার বিভিন্ন গ্রাম। সিডরে জলোচ্ছাসে এক গ্রামের মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে অন্য গ্রামে। শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষ মারা গেছে। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, গাছপালা, মৎস্যখামার ও গবাদিপশুসহ মানুষের সহায় সম্পদ ভেসে গেছে। দিনের পর দিন নদী-খালে গবাদিপশুর সঙ্গে মানুষের মৃতদেহ ভাসতে দেখা গেছে। সিডরে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলা। এখানে সিডরের আঘাতে নিহত অনেকের লাশ এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সরকারি হিসেবে সিডরে শুধুমাত্র শরণখোলা উপজেলায় ৬৯৫ জন মারা গেছে এবং এখনো পর্যন্ত ৭৬ জন নিখোঁজ আছে। তবে বেসরকারি হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি।

বিষ্ণু প্রসাদ চক্রবর্ত্তী, ইউএনবি।