বাঘের খাঁচায় ১০ মিনিট, অতঃপর...

গেলো সাড়ে তিন মাস আগে দেশে জন্ম নিয়েছে বরফ যুগের সাদা বাঘের শাবক। প্রথমটি চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় ও দ্বিতীয়টি জন্ম নেয় গাজীপুর বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে। কেমন আছে দেশের প্রথম সাদা বাঘ শাবক? সরাসরি বাঘ শাবক দেখতে গেলো রোববার ৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় যাই। চিড়িয়াখানায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই গেলাম বাঘের খাঁচার সামনে। সবুজ কাপড়ে ঢাকা খাঁচা। এর মানে এখনো সরাসরি দর্শণার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি বাঘ শাবক। 

ডোরা কাটা ‘বাংলার বাঘ’ দেশের জাতীয় প্রতীক, এ নিয়ে মানুষের যেমন আগ্রহের শেষ নেই, তেমনি গেলো কয়েক মাস ধরে সাদা ডোরা বাঘ শাবকের জন্ম নিয়েও হইচই সকল মহলে। কথা হলো চিড়িয়াখানার কিউরেটর শাহাদাত হোসেন শুভর সঙ্গে। তিনি জানালেন, এ ক’দিনেই বনের বাঘের শাবকের মতোই কিছুটা বন্য আচরণ দ্রুত রপ্ত করেছে সাদা শাবকটি। মূলত বাঘিনী দুই শাবককে খাবার খাওয়া, শিকার করার ধরণ বা শক্রকে ভয় দেখানোর মতো ভঙ্গিগুলো শিখিয়ে থাকে।

তবে শাবকগুলো খাঁচায় পুরোপুরি বন্য না হলেও বন্য এবং পালিত এ দু’ই সুবাসেই বড় হচ্ছে বলে জানায় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার সাদা ও হলুদ দুটি বাঘ শাবকই মেয়ে বাঘ। গেলো ১৯ আগস্ট চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় ও ২২ আগস্ট গাজীপুরে জন্ম নেয় সাদা বাঘ। 

চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার পরী নামক বাঘিনী জন্ম দেয় প্রথম সাদা বাঘটি। দেখা গেলো, খাঁচার ভেতরে নিয়মিত শাবকগুলোর কাছেই থাকে বাঘিনী। মাঝে মাঝে মুখ ঘষে আদর করে আর শাবকরাও শিশুসুলভ নানান অঙ্গভঙ্গিতে খেলা করছে। সাদা শাবকটি অন্য বোনটির সঙ্গে মায়ের সঙ্গে খেলা করে। দৌড়ঝাঁপ করে একটু ক্লান্ত হলে আবার বাঘিনীর কাছে ছুটে যায়।

কিউরেটর শাহাদাত হোসেন শুভ জানালেন, অচেনা কাউকে দেখলেই বাঘিনী রেগে যায়। আর শাবকগুলোও ভয় পায়। কিউরেটরের সঙ্গে খানিকটা ভাবও দেখা গেলো শাবকগুলোর। তিনি খাঁচায় প্রবেশ করতেই দৌড়ে এসে খুনসুটি জুড়ে দেয়। হলুদ শাবকটি লাফালাফি করে খেলতে শুরু করে।

লুকিয়ে কিছুক্ষণ ছবি-ভিডিও নেয়ার পর আমি খাঁচার ভেতরে প্রবেশের করতেই সাদা শাবকটি একটু দূরেই সরে গেল। বুঝতে পেরেছে তাদের আবাসে অপরিচিত কেউ পা রেখেছে! এরপর হঠাৎ খেয়াল করি, সাদা শাবকটি শিকারের ভঙ্গি করে দু’পা সামনের দিকে মেলে ধরে ছুটে আসার চেষ্টা করছে, যাতে দৌড়ে শিকারকে কাবু করতে পারে। বিষয়টি বুঝে সাবধানে খাঁচার বাইরে পর্দার আড়ালে চলে গেলাম। এরপরই চিত্র ভিন্ন...সাদা শাবকটি আবারো নিজস্ব ভঙ্গিতে খেলতে শুরু করে। বুঝতে বাকি রইলো না যে, সাদাটির অনুভূতি প্রখর ও অন্য শাবক থেকে কিছু ভিন্ন, শক্তিশালী ও তেজী। কিউরেটর জানালেন অপরিচিত কাউকে দেখলেই শাবকগুলো ভয় পেয়ে যায় এবং অনেক ক্ষেত্রে বন্য অাচরণ করে থাকে। তাই দশ মিনিট খাঁচার ভেতর পর্যবেক্ষণ, ছবি ও ভিডিও ধারণ করে বেরিয়ে আসি।

চিড়িয়াখানার কিউরেটর জানান, শাবকগুলো যাতে রোগাক্রান্ত না হয় এজন্য বিশেষ খেয়াল রাখতে হয়। আরো কিছু সময় শাবকগুলোকে আড়ালেই রাখা হবে। এখন প্রতিদিন একবেলা করে প্রতিটি শাবককে এক কেজি মাংস খেতে দেয়া হচ্ছে।

গবেষকরা মনে করেন, ‘সাদা বাঘ’ বাংলার বাঘের আরেক বৈশিষ্ট্য। এমন বাঘ এখন সচারচর দেখা না গেলেও এক সময় বরফ যুগে এমন বাঘ ভারতের আসাম, বিহার, সুন্দরবন অঞ্চলের মধ্য প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ এবং অন্যান্য রাজ্যে দেখা যেত। এই বাঘেরও রয়েছে ডোরাকাটা কালো দাগ।

গবেষকরা জানান, বিলুপ্ত হলেও জিনগত বৈশিষ্ট্য বহন করায় কিছু বাঘ প্রজননের সময় সাদা শাবক জন্ম দিয়ে থাকে। জীব-বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পূ্র্ব-পুরুষরা সাদা থাকার কারণে সাদা শাবক জন্ম দেয়া বাঘে জিনগত বৈশিষ্ট্য সুপ্ত অবস্থায় ছিল। তবে সুন্দরবনে এমন বাঘের কোন অস্তিত্ব আছে বলে জানা নেই দেশের বাঘ গবেষকদের। তবে ভারতে যে ক'টি সাদা বাঘ জন্ম নিয়েছে তা প্রজননের মাধ্যমে করা হয়েছে। আর ঘটনাক্রমে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার সাদা বাঘ জন্ম নিয়েছে বলে মনে করছেন প্রাণীবিদরা।

উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, এই জাতের বাঘের বৈজ্ঞানিক নাম Panthera tigris tigris এদের শরীরের সাদা লোমের কারণ ফিওমেলানিনের অনুপস্থিতি। যা থাকলে বাঘের লোম সাধারণত কমলা বা বাদামি রঙের হয়ে থাকে। অন্যান্য রয়েল বেঙ্গল বাঘের সাথে তুলনা করলে দেখা যায় যে, সাদা বাঘ তুলনামূলকভাবে দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং তাদের ওজনও হয় বেশি। জন্মের সময়ও তারা তুলনামূলকভাবে কিছুটা বড় থাকে। ২-৩ বছর বয়সে সাদা বাঘ প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে থাকে। সাদা পুরুষ বাঘ সাধারণত ওজনে ২০০ থেকে ২৬০ কেজি এবং দৈর্ঘ্যে ৩ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। প্রকৃতিগতভাবে দশ হাজারে একটি বাঘ জন্মের ক্ষেত্রে সাদা রঙের হয়ে থাকে। মজার কথা হলো, বাঘের ডোরাকাটা দাগ এদের চামড়ার মধ্যেই থাকে। একটা সুস্থ বাঘের সব লোম চেছে ফেললেও ডোরাকাটা দাগ থেকেই যায়। সাদা বাঘের ক্ষেত্রেও তেমনই।

লেখক: পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী বিষয়ক সাংবাদিক
ই-মেইল: mithu.reporter@gmail.com