কুমির নয়: ডিম ফুটে বের হলো এ কিসের বাচ্চা?

প্রথমে দেখে মনে হতে পারে কুমির ছানা। তবে আকারে ছোট হওয়ায় রক্তচোষা প্রাণী গিরগিটি ভেবে আঁতকে উঠতে পারেন অনেকেই। কিন্তু প্রাণীটি প্রকৃতির বন্ধু চতুষ্পদ এক নিরীহ সরীসৃপ প্রজাতির; নাম অঞ্জন বা আর্জিনা। দেশে এমন কয়েক প্রজাতির দেখা মেলে। তবে উন্নয়নের জোয়াড়ে বনাঞ্চল ও ঝোপঝাড় কমার কারণে হুমকির মুখে সরীসৃপগুলোর অস্তিত্ব। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাণী সংরক্ষণ সংস্থা- আইইউসিএন’র বন্যপ্রাণীর রেডলিস্ট বলছে, কয়েক প্রজাতির অঞ্জন এখন বিলুপ্তির পথে!

প্রাণীবিদরা জানান, টিকটিকির মতো সরীসৃপ দলের প্রাণী অঞ্জন, এর ইংরেজি নাম skink, এটি Reptilia শ্রেণির Eutropis গোত্রের প্রাণী। তবে অবাক করা বিষয়; প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে অঞ্জন প্রজাতির প্রাণীর ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো হয়েছে। পাহাড়ি অঞ্চল বান্দরবানের একটি এলাকায় কুঁড়িয়ে পাওয়া তিনটি ডিম থেকে বৈজ্ঞানিক পন্থায় বাচ্চা ফুটিয়েছেন আদনান আজাদ আসিফ নামের একজন বন্যপ্রাণী গবেষক। যিনি বান্দরবানের একটি কুমির প্রজনন কেন্দ্রের প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন।

আদনান আজাদ আসিফ বলেন, ‘পাহাড়ী এলাকায় একদল লোক মাটি কাটছিল, আমি ঠিক পাশেই ছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করি মাটির ভেতরে সাদা সাদা কি যেন। কাছে গিয়ে দেখি ডিম। প্রথমে সন্দিহান ছিলাম প্রজাপতি নাকি গিরগিটির ডিম। মোট ৭টি ডিম পাই, ৪টা ভাল ছিল। বাকি ৩টি কোদালের আঘাতে নষ্ট হয়ে যায়।'

তিনি বলেন, ‘আমার খুব মায়া লাগে, তাই ডিমগুলো থেকে বাচ্চা ফোটানোর সিদ্ধান্ত নিই। যেহেতু গিরগিটি মাটির নিচে ডিম দেয়, ডিমগুলো আলো থেকে দূরে রাখতে হয়। তাই একটি পাত্রে শুকনা বালি দিয়ে ডিম বালির ভেতরে রেখে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে অন্ধকার ঘরে বাচ্চা ফোটার অপেক্ষা করি। এ বছরের ২৯ আগষ্ট ডিমগুলো বসানোর পর ২১ সেপ্টেম্বর প্রথম বাচ্চা ডিম ফেটে বের হয়। পরে প্রজাতি নির্ণয় করে দেখা গেলো বাচ্চাগুলো অঞ্জন প্রজাতির। এরপর সেগুলোকে প্রকৃতিতে উন্মুক্ত করে দিই।’

এ বিষয়ে প্রাণীবিদরা জানান, গিরগিটি বা অঞ্জন প্রজাতির যেকোন প্রাণী বন্য। পোকা-মাকড় খেয়ে এরা প্রকৃতিতে পতঙ্গের ভারসাম্য রক্ষা করে। এসব পোকা-মাকড়ের মধ্যে মশা ও মানুষের জন্য ক্ষতিকর পতঙ্গগুলোও থাকে। ২০১৫ সালের আইইউসিএন’ রেডলিষ্ট অনুযায়ী, এ ধরণের লিজার্ড প্রজাতির প্রাণীর সংখ্যা ৩৪টি।

জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রাণীবিদ ড. এম এম ফিরোজ জানান, লিজার্ড গোত্রের অন্তর্ভুক্ত এমন তিন-চারটি প্রজাতির রয়েছে। এরমধ্যে ছবি দেখে বাচ্চাগুলোকে সিলভার গ্রাস স্কিংক অথবা কমন গ্রাস স্কিংক প্রজাতির (অঞ্জন, অঞ্জনি শ্রেণিভুক্ত) ধারণা করা হচ্ছে।

এদিকে আইইউএন’র রেড লিষ্ট থেকে এই দু’প্রজাতির অঞ্জন সম্পর্কে জানা যায়, দেশে বেশ কয়েক ধরনের অঞ্জন প্রজাতির প্রাণী রয়েছে। এরমধ্যে ছবি সাথে মিলিয়ে ‘Lygosoma albopunctata ও Eutropis multifascita’-এই দুই প্রজাতির ডিম থেকে ফোটা অঞ্জন এর বাচ্চাগুলোর সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। সিলেট বিভাগের কিছু জায়গা, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি অঞ্চলে দেখে মেলে এই প্রাণী।

প্রাণীবিদ ড. এম এম ফিরোজ বলেন, বাচ্চাগুলোর ছবি দেখে অঞ্জন গোত্রের মনে হয়েছে। যেহেতু এগুলোর কয়েক ধরনের প্রজাতি বৈচিত্র রয়েছে। তবে Silver grass skink বা Common grass skink প্রজাতির সঙ্গে এদের মিল পাওয়া যায়। এই প্রাণীবিদ আরো জানান, অঞ্জন বন্যপ্রাণী। এমন প্রাণী প্রজননের নিয়ম নেই প্রচলিত আইনে। কিন্তু যেহেতু ডিমগুলো পরিত্যক্ত ছিল, সেক্ষেত্রে এই উদ্যোগটিকে সাধুবাদ দেয়া যায়। তবে কেউ যেন অতি উৎসাহী হয়ে ডিম থেকে বাচ্চা না ফোটায়-পরামর্শ দেন তিনি। তিনি বলেন, এতে হুমকিতে পড়তে পারে প্রাণীটির অস্তিত্ব।

প্রাণীবিষয়ক বই থেকে জানা যায়, অঞ্জন বা অঞ্জনি গ্রাম বাংলায় আর্জিনা নামে পরিচিত। অঞ্চলভেদে উভচর এই প্রাণীটি অ্যাঞ্জন, সাপের আঁচিল, সাপের লাঠি পরিচিত। খাদ্য তালিকায় ছোট পোকা-মাকড়, লার্ভা, ক্ষুদ্র জলজ প্রাণী ইত্যাদি। এদের দৈর্ঘ্য সর্বোচ্চ ৩৭ সেমি. এবং প্রচলিত দৈর্ঘ্য: ২৫, যা চঞ্চুর-বেরুতে দৈর্ঘ্য ৯ সেমি.। দেহের ওপরের অংশ বাদামি থেকে ধূসর। তবে প্রয়োজনে রং পরিবর্তন করতে পারে। যেমন; হালকা জলপাই বাদামি, জলপাই ধূসর বা হলদে। পিঠের ওপর ও পাশে নানান রকমের ফোঁটা আর দাগ থাকে। মূলত কীটপতঙ্গভোজী হলেও ডিম, ছোট ছোট কাঁকড়া ও অন্যান্য ছোট মেরুদণ্ডী প্রাণী খেয়ে থাকে। মূলত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর প্রজননকাল প্রাণীটির।

অঞ্জন প্রজাতির বাচ্চা ফোটানো গবেষক আদনান আজাদ আসিফ জানান, ম্যাকাও, কাকাতুয়াসহ শতাধিক প্রজাতির পাখির ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর অভিজ্ঞতা আছে তার। কুমিরেরও ডিম ফুটিয়েছি তিনি। এছাড়া সরিসৃপের মধ্যে কুড়িয়ে পাওয়া দাঁড়াশ ও গোখরার ডিম ফুটিয়েও বাচ্চা প্রকৃতিতে অবমুক্ত করেছেন এই ফিল্ড বায়োলজিষ্ট।

লেখক: পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী বিষয়ক সাংবাদিক
ইমেইল: This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.