ভাষা শহীদ দিবস পালন করলেন আসামের বাঙালিরা

মোমবাতি প্রজ্জ্বালন ও স্মরণ সভার মাধ্যমে ভাষা শহীদ দিবস পালন করেছেন আসামের বাঙালিরা। মাতৃভাষার মর্যাদার জন্য বাংলাদেশের বাঙালিরা ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। আসামের বাঙালিদের কাছে একইভাবে শোকাবহ হয়ে আছে উনিশে মে। ১৯৬১ সালের এই দিনে মাতৃভাষার মর্যাদা ও সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান আসামের ১১ জন বাংলাভাষী মানুষ।

বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলনে প্রাণ হারfন আসামের ১১ জন

আসামে ও বহির্বিশ্বে থাকা বরাক উপত্যকা অঞ্চলের মানুষ প্রতি বছর নানা আনুষ্ঠানিকতায় দিনটি পালন করে থাকেন। বরাক উপত্যকার বিভিন্ন শহরে স্থাপিত শহীদ বেদিতে তারা পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান।

১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিমল প্রসাদ চালিহা অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা করতে বিধানসভায় একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। উত্তর করিমগঞ্জ আসন থেকে নির্বাচিত বাঙালি বিধায়ক রনেন্দ্র মোহন দাস তাৎক্ষণিকভাবে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, এই প্রস্তাব গৃহীত হলে এক-তৃতীয়াংশ মানুষের ভাষাকে রাজ্যের অপর দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।

ব্রিটিশ আমল থেকে বরাক উপত্যকার কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেলায় বাঙালিদের বসবাস। তিন জেলার ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ বাংলায় কথা বলে। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে কোনো এলাকায় বাংলা-ভাষাভাষী মানুষের এটাই সর্বোচ্চ হার।

বিতর্ক ও বিরোধিতার মধ্যেই ১৯৬০ সালের ২৪ অক্টোবর আসাম বিধানসভা অসমিয়াকে রাজ্যের সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দিয়ে প্রস্তাব পাশ করে। এভাবে অসমিয়াকে বাংলা ভাষাভাষীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে আন্দোলন করতে ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বরাক অঞ্চলের মানুষেরা কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন।

১৯৬১ সালের ১৯ মে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদের ডাকে শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দির মহকুমা শহরগুলোতে বিক্ষোভ ও সকাল-সন্ধ্যা হরতাল চলছিল। শিলচরে বিক্ষোভকারীরা রেলপথে অবস্থান নেন। শিলচর থেকে শেষ ট্রেন ছাড়ার কথা বিকেল ৪টায়। ওই সময়টুকু পেরোলেই হরতাল কার্যত শেষ হয়ে যেত। কিন্তু তার আগেই দুপুরের পরপর রেল স্টেশনে আসে আসাম রাইফেলসের সদস্যরা।

বেলা আড়াইটার দিকে কাটিগোড়ায় বিক্ষোভ থেকে গ্রেপ্তার নয় আন্দোলনকারীকে নিয়ে পুলিশের একটি ট্রাক শিলচর রেল স্টেশনের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। এ দৃশ্য দেখে রেলস্টেশনে থাকা বিক্ষোভকারীরা জোরে স্লোগান ও প্রতিবাদ করতে থাকেন। এতে ভীত হয়ে ট্রাকের চালক ও তাতে থাকা পুলিশ সদস্যরা পালিয়ে যান।

হঠাৎ অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর পরপর স্টেশনে মোতায়েন আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ শুরু করে। ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ ১২ জনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। এদের মধ্যে ৯ জন ওইদিনই মারা যান। দুইজন পরদিন মারা যান।

আসামে বাংলা ভাষা আন্দোলনের শহীদেরা হলেন- কানাইলাল নিয়োগী, চান্দিহরণ সূত্রধর, সত্যেন্দ্র দেব, কুমুদ রঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তারণী দেবনাথ,সচীন্দ্র চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকমল পুরকায়স্থ ও কমলা ভট্টাচার্য্য।

পরদিন ২০ মে জেলা প্রশাসন শিলচরে কার্ফ্যু জারি করে। ওই কার্ফ্যু অগ্রাহ্য করে শহীদদের মরদেহ নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে মানুষ। বাঙালিদের অব্যাহত প্রতিবাদের মুখে একপর্যায়ে আসাম সরকার ভাষা বিষয়ক প্রজ্ঞাপন বাতিল করে এবং বরাক উপত্যাকা অঞ্চলে বাংলাকে সরকারি ও দাপ্তরিক ভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।

ভাষা শহীদ দিবস উপলক্ষে বরাক অঞ্চলে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। সমবেতরা সমস্বরে গেয়ে ওঠেন- শোনো ডাকে ওই একাদশ শহীদেরা ভাই/ আর দেরি নয় দেরি নয় দেরি নয়।