আপনি পড়ছেন

"হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক আগামীকালের জন্য সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে।" (সুরা হাশর ৫৯: ১৮)। এই আগামীকাল হল আখিরাত। এর বিপরীত আজ হল দুনিয়ার জীবন।

muhasabah or self criticismতোমার হিসাব নেয়ার আগে তুমি নিজেই নিজের হিসাব নাও, প্রতীকী ছবি

আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা'লার এ কথার তাৎপর্য হল আজকের ক্ষণস্থায়ী দিনের আনন্দ উপভোগ করতে গিয়ে কালকের চিরস্থায়ী জীবন যেন বরবাদ হয়ে না যায়। তার সময়, সম্পদ, সামর্থের যাবতীয় পুঁজি এখানকার সুখ-সম্ভোগেই ব্যয় করে ফেললো, তো কালকের সেই দিনে তার কোন আশ্রয় থাকবে না। তাই বুদ্ধিমান হল সে, যে আগামীকালের জন্য চিন্তা করে, ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

রসূল (সা.) বলেছেন,

"বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি যে আত্মসমালোচনা করল ও মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের জন্য আমল করল। আর নির্বোধ আর অক্ষম হল সে, যে নিজের নফসের অনুসরণ করে, আর আল্লাহর কাছে কল্যাণের আশা করে" (তিরমিযী)

হাদীসে উল্লেখিত ‘মান দানা’ নাফসাহু বাক্যাংশের তাৎপর্য হল কিয়ামতের দিন আত্মাকে হিসাবের সম্মুখীন করার আগেই ব্যক্তি দুনিয়াতেই নিজেই নফসের হিসাব নিকাশ করে নিবে। উমর (রা.) বলতেন, "তোমার হিসাব নেয়ার আগেই তুমি নিজেই নিজের হিসাব কর এবং সেই মহাসমাবেশে হাজির হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। যে ব্যক্তি দুনিয়াতে তার হিসাব নেয় কিয়ামতের দিন তার হিসাব অত্যন্ত হালকা ও সহজ হবে।" (তিরমিযী )

মুহাসাবা বা আত্মসমালচনা

ইসলামী পরিভাষায় 'মুহাসাবা' শব্দের মূল হল 'হিসাব' শব্দ হতে। আরবী অভিধান লিসানুল আরবে বলা হয়েছে, মুহাসাবা শব্দের অর্থ হল গণনা করা, হিসাব করা। আত্মসমালোচনাকে আরবীতে বলে, মুহাসাবায়ে নাফস। ইবনুল কায়্যিম (রহ.) সুরা হাশরের ১৮ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তা'লা প্রত্যেক মুমিনের জন্য আত্মসমালোচনাকে ওয়াজিব করে দিয়েছেন।

হাসান বসরী বলেন, যারা দুনিয়াতে আত্মসমালোচনা করবে কিয়ামতের দিন অবশ্যই তার হিসাব হালকা হবে।

মাইমুন বিন মিহরানের মতে, কোন বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত মুত্তাকী হতে পারে না যতক্ষণ না নিজ আত্মার হিসাব করে। এমনকি শরীকদাররা পরস্পরের যেরকম হিসাব করে তার চেয়েও শক্ত করে নিজের হিসাব না নেয়।

মালিক বিন দিনার বলেন- আল্লাহর রহমত ঐ বান্দার প্রতি যে তার নফসকে কোন (কোন মন্দ কাজ করার পর) বলে, 'তুমি কি এর সাথী নও? তুমি কি এর সাথী নও?’ অতঃপর তাকে নিন্দা করে; এরপর তার লাগাম টেনে ধরে; অতঃপর আল্লাহর কিতাবের উপর তাকে আটকে রাখে। তখন সে হয় তার পরিচালক।

আত্মসমালোচনার বিষয়

আত্মসমালোচনার দুটি দিক:

১. যে কাজ করা হয়নি

২. যে কাজ করা হয়ে গেছে

১. যে কাজ এখনো করা হয়নি: এ ক্ষেত্রে আত্মসমালোচনা বা আত্মপর্যবেক্ষণ হল কাজটা ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ কিনা সবার আগে তা দেখা দরকার। অতঃপর দেখতে হবে কাজটা কি নিয়তে করা হচ্ছে। লোক দেখানোর জন্য, না দুনিয়ার কোন স্বার্থে। অর্থাৎ এর পেছনে উদ্দেশ্য কি- লোক দেখানো প্রদর্শনী বা ক্ষুদ্র বৈষয়িক স্বার্থে হলে নিয়ত সংশোধন করে নিতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাজটা করতে হবে।

কেন শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য?

কারণ এ কাজের জন্য যে জীবন, যে উপকরণ, সামর্থ্য, জ্ঞান, বুদ্ধি, সক্ষমতা সব তাঁরই দান। তাঁর দেয়া জিনিষ দিয়ে নিজের বা অন্যের সন্তুষ্টি তিনি মেনে নেন না। আপনি হলেও তো নিতেন না। প্রদর্শনী বা রিয়া এক প্রকার শিরকী কাজ। অধিকাংশ মানুষ এ সমস্যায় আক্রান্ত হই আমরা। আত্মসমালোচনার একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মানুষের প্রশংসার জন্য আকাংখী না হওয়া। এর আরেকটা দিক হল মানুষের প্রশংসা থেকে অমুখাপেক্ষী হয়ে গেলে তাদের অন্যায় সমালোচনায় আপনি আর কষ্ট পাবেন না।

২. অতীতে সংঘটিত কোন বিষয়ে আত্মসমালোচনা:

অতীত আশ্রয়ী জীবন স্থবির। মানসিক বেদনা ও রোগের উৎস। অতীতে অনেক ভুল করেছি, তো সেগুলো নিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না। ভুলগুলো চিহ্নিত করতে হবে। গুনাহগুলোর জন্য আন্তরিকভাবে তাওবা করতে হবে। সেগুলো যেন আবার না হয়ে যায় সে ব্যাপারে মজবুত হতে হবে। আর ভাল কাজগুলো করতে হবে। অতীতের আত্মসমালোচনা খুবই জরুরি যদি তার থেকে এরকম ফায়দা নেয়া যায়। নাহলে শুধুই বেদনার স্মৃতি না হয় গুনাহর উৎস। কারণ অতীতের গুনাহর জন্য যদি আপনি আমি তৃপ্তি ও আনন্দ বোধ করি তাহলে তো সে গুনাহ থেকে বাঁচা গেল না। তা এখনও পাপের পাল্লা ভারী করে চলেছে।

নবতর গুনাহর নানা ধারণা

গুনাহর কাজগুলো সুস্পষ্ট ও সুচিহ্নিত। নেককাজগুলো তথা আল্লাহর হুকুমগুলো পালন না করা এবং আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজগুলো করে ফেলা। শয়তান বরাবরই নিষিদ্ধ কাজগুলোকে কল্যাণ ও উন্নয়নের মোড়ক পড়ায়। আদম (আ.) কে সে বলেছিল- ঐ গাছের ফল খেলে তারা ফিরিস্তা হয়ে যাবেন, অনন্ত জীবন লাভ করবেন এবং চিরস্থায়ী রাজত্বের অধিকারী হবেন। (আরাফ ৭: ২০, ত্বহা ২০: ১২০ )

আজকেও সে ধারণা অব্যাহত। উলঙ্গপনাকে আধুনিকতা বা শিল্প; নাটক-সিনেমায় অশ্লীলতা ও ব্যভিচার হল বিনোদন। কোনোটা সংস্কৃতি বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কোনোটা মুরাল বা ভাস্কর্য; আবার খেলার নামে চলছে জুয়ার অবাধ চর্চা। খেলা-বিনোদন-সংস্কৃতি চর্চার নামে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ সময়ের অপচয় চলছে দেদারসে। এভাবে পাপগুলো আজ আর পাপের নামে হয় না। সেগুলোকে সুন্দর সুন্দর নামের মোড়ক পড়ানো হয়েছে। গুনাহর কাজ গুনাহই। আমি-আপনি তাকে সুন্দর নামে ডাকলে তার চরিত্র বদলে যাবে না। ময়লা আবর্জনা-মলকে বিরিয়ানী বলে সার্ভ করলে কি নিব আমরা? থাকবো সেখানে? দুর্ভাগ্য- টিকিট কেটে, মোবাইল ডাটা কিনে, চাঁদা দিয়ে সব হারামে জড়িত হচ্ছি আজ আমরা।

আল্লাহকে লজ্জা করি

রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে লজ্জা কর। আমরা বললাম- হে আল্লাহর রসুল (সা.), আমরা তো নিশ্চয়ই লজ্জা করি। আলহামদুলিল্লাহ্। তিনি (সা.) বললেন- না তা নয়; বরং আল্লাহ তা'লাকে যথযথভাবে লজ্জা করার অর্থ এই যে, তুমি তোমার মাথা এবং এর মধ্যে যা কিছু আছে তা সংরক্ষণ করবে এবং পেট ও এর মধ্যে যা কিছু আছে তা হিফাযত করবে। মৃত্যুকে এবং এরপর পচে গলে যাবার কথা স্মরণ করবে। আর যে লোক পরকালের আশা করে, সে যেন দুনিয়াবি জাঁকজমক পরিহার করে। যারা এইসব কাজ করতে পারে তারাই আল্লাহকে যথযথভাবে ভয় করে।" (তিরমিযী ২৪৫৮)

মাথা এবং তার মধ্যে যা আছে তা সংরক্ষণ অর্থ চিন্তার পবিত্রতা সংরক্ষণ। বলা হয়, তুমি কোন ধরনের চিন্তার মধ্যে সময় কাটাচ্ছ তার দিকে নজরদারি কর। কারণ তোমার চিন্তা কথা ও কাজ হিসেবে প্রকাশিত হয়। তোমার কথা ও কাজগুলি খেয়াল রাখ, কারণ সেগুলোই তোমার অভ্যাসে পরিণত হয়। আর তোমার অভ্যাসগুলির দিকে খেয়াল রাখ কারণ সেগুলোই তোমার চরিত্রে পরিণত হয়।

চিন্তার থেকেই সবকিছুর উৎপত্তি, তাই সবাই কি ধরনের চিন্তার মধ্যে জীবনযাপন করছি ভেবে দেখি। আমার আশা-আকাঙ্ক্ষা কোন জিনিষকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে? খাওয়া দাওয়া, আরাম-আয়েশের উপকরণ, আত্মীয়-পরিজন, ফূর্তির আয়োজন- কি নিয়ে আপনার চিন্তার জগত? নাকি কোন ক্যারিয়ার আর টাকা কামানোর?

"জেনে রাখ, পার্থিব জীবন তো শুধুমাত্র ক্রীড়া-কৌতুক, জাঁকজমক, পারস্পরিক গৌরব ও অহংকার এবং ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এর উপমা যেন বৃষ্টি, যা দ্বারা উৎপন্ন ফসল-সম্ভার কৃষককে চমৎকৃত করে; অতঃপর তা শুকিয়ে যায়, এবং তোমরা দেখতে পাও তা হলুদ বর্ণ ধারণ করে, অবশেষে তা খড়-কুটায় পরিণত হয়। পরকালে রয়েছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার সামগ্রী ছাড়া কিছুই নয়।" (সুরা হাদীদ ৫৭: ২০)

এই প্রতারণার সামগ্রী নিয়েই ব্যস্ত সবাই। খড়-কুটার পিছনে ছুটছি পাগলের মতো। শাস্তি ধেয়ে আসছে প্রবল বেগে দুনিয়া ও আখিরাতের। আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি।

-পেট ও তার ভেতরে যা আছে তার হিকমতের তাৎপর্য হল- তাতে যেন হারাম কিছু না ঢুকে। নতুন মজাদার খানার জন্য পাগল হচ্ছি। কিন্তু রসুলুলাহ বলেন-

"মানুষ পেটের চেয়ে নিকৃষ্ট কোন পাত্র পূর্ণ করে না। মেরুদণ্ড সোজা রাখতে পারে এমন কয়েক গ্রাস খাবারই আদম সন্তানের জন্য যথেষ্ট।" (তিরমিযী ২৩৮০)

নিত্য নতুন বিলাসী মজাদার খাবার, অমুক কিচেন, তমুক ইন- এর পেছনে সম্পদের অপচয় চলছে। এর জন্যই তো নানা দুর্নীতি। এগুলো করতে পারা, দেখাতে পারা Facebook- এ আর অনুষ্ঠানে- এই তো? এর বিনিময়ে জাহান্নাম খরিদ করছি- চিরস্থায়ী! কি বুদ্ধিমান আমরা?!

নবী (সা.) বলেছেন, এ বিষয়গুলির হেফাজতই আল্লাহপাককে প্রকৃতভাবে লজ্জা করা। আমরা করছি কী? হিসাব নেই নিজের।

রমজান ও মুহাসাবা

রমজানের গুরুত্বপূর্ণ আমল এই মুহাসাবা- আত্মসমালোচনা:

"যে ব্যক্তি রমজানের সিয়াম পালন করল ঈমান ও ইহতিসাব সহকারে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দিবেন।" (বুখারী)

ইহতিসাব অর্থ সওয়াবের আশা। এর আরেক অর্থ আত্মসমালোচনা। এর মূল শব্দও হিসাব। অর্থ গণনা, পর্যালোচনা, calculate, reckon ইত্যাদি। রোজা ইহতিসাবের পয়গাম নিয়ে আসে। এ বছরও এসেছিল, চলে যাচ্ছে। আর এক বা দুই দিন। একটু নিরিবিলি সবাই হিসাব করি- কতদূর কি করতে পারলাম। ক্ষমা ও মাফির পথে কতদূর এগুলাম? নিজেকে সংশোধন ও পরিবর্তন করলাম কতটুকু। ভাল কাজগুলো কোনটা কোনটা শুরু করেছি? কোন কোন নাফরমানি ছেড়েছি। অনেক কিছুই তো হয়নি আমার ও আপনারও। রসুল (সা.) এর কথা অনুযায়ী রমজান পেয়েও মাফ করাতে না পারাটা অভিশপ্ত হওয়ার আলামত। আমরা কি অভিশপ্ত হব? কখনই নয়, ইনশাআল্লাহ। হাতে আর যা সময় আছে কাজে লাগাই। ক্ষমা চাই রব্বুল আলামীনের কাছে, তওবা করি, নিয়ত করি নিজেকে বদলে ফেলার। তওফিক চাই যিনি, আমার ও আপনার মালিক তার কাছে। আশাবাদী হই। চেষ্টা করি। কাজ করি। ভাল ভাল।

আর হ্যাঁ রমজানের শেষ বেলা ফিতরা ঠিকমত আদায় করি। এক সা' খাদ্য যা আমরা খাই। মূলত: চাল। তা দিয়ে অথবা তার মূল্য দিয়ে। ইরাকী হিসাবে এক সা’ তিন কেজি তিনশ গ্রাম। মদীনার সা' কিছুটা কম। অভাবের সময় গরীবকে বেশী করে দেই। বিতর্ক পরিহার করে কাজ করি। আল্লাহ সবাইকে তওফিক দান করুন।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.