আপনি পড়ছেন

লস্কর-ই-তৈয়বা (এলইটি) এবং জামাত-উদ-দাওয়ার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হাফিজ মোহাম্মদ সাঈদকে বিভিন্ন জঙ্গিবাদী সংগঠনকে মদদ দেওয়ার অভিযোগে সম্প্রতি ৩৩ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে পাকিস্তানের আদালত। হাফিজের কারাদন্ড অবশ্য নতুন কিছু নয়। বহুবার তাকে গৃহবন্দী রেখেছে পাকিস্তান। বন্দিদশাতে তাকে সাংবাদিক সম্মেলন করতেও দেখা গেছে। বলা যায়, আন্তর্জাতিক চাপ বাড়লেই তাকে জেলে ভরা হয়।

hafiz saeed sentenced 33 yearsহাফিজ সাঈদ

২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতের জাতীয় সংসদে হামলা এবং ২০০৬ সালে মুম্বাইয়ে ট্রেন বিস্ফোরণেও তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান দাবি করেছিল, হাফিজ তাদের সেন্ট্রাল জেলে রয়েছে। কিন্তু তাকে রাখা হয়েছিল লাহোরের একটি রেস্ট হাউজে।

কাকতালীয় হলেও সত্যি ২০০৮ সালে মুম্বাই বিস্ফোরণের মূল ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে পরিচিত হাফিজকে জঙ্গিবাদীদের মদদে নজরদারির জন্য গঠিত প্যারিসের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ)-এর পর্যালোচনা বৈঠক এলেই শাস্তির ঘোষণা করে ইসলামাবাদ। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে এফএটিএফ-এর বৈঠকের তিন মাস আগে একইভাবে ১১ বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করে জেলে ভরা হয়। এবারও এফএটিএফ-কে খুশি করতেই হাফিজের শাস্তি। গত বছর জানুয়ারি মাসে জঙ্গিবাদীদের অর্থায়ণে জড়িত থাকার অপরাধে লস্করের অপারেশন কমান্ডার জাকি-উর-রহমান লাখভীকেও কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পাঞ্জাবের কাউন্টার টেরোরিজম ডিপার্টমেন্ট (সিটিডি) তাকে মুম্বাই হামলার জন্য গ্রেপ্তার করলেও ২০১৫ সাল থেকেই সে জামিনে রয়েছে। লাখভীও সাজা হয় এশিয়া প্যাসিফিক জয়েন্ট গ্রুপ (এপিজেডি) এবং এফএটিএফ-এর বৈঠককে সামনে রেখে।

৯/১১-র জঙ্গি হামলার পর থেকে লস্কর-ই-তৈয়বা ও জামাত-উদ-দাওয়া পাকিস্তানে নিষিদ্ধ। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, এটি শুধুই ঘোষণা। তারা রাষ্ট্রীয় মদদ পেয়ে থাকেন। ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলাতেও সরকারি মদদের প্রমাণ আছে। ভারতের জাতীয় সংসদে হামলার জন্য ডিসেম্বর ২০০১ থেকে মার্চ ২০০২ সালের মধ্যে অন্তত তিনবার গ্রেপ্তার হয়ে মুক্তি পেয়েছে। মুম্বইয়ের রেল বিস্ফোরণে জড়িত থাকায় এপ্রিল ২০০৬ থেকেও অক্টোবর ২০০৬ সাল পর্যন্ত তাকে গৃহবন্দী করা হয়েছিল। এরপর ২০০৯ সালে পাকিনস্তানি আদালতই বলেছে, জামাত-উদ-দাওয়া-র প্রতিষ্ঠাতা হাফিজকে গৃহবন্দি করে রাখা সংবিধান বিরোধী। অথচ হাফিজের ছেলে তালহা সাঈদ লাহোরে বসে এখনও ভারত ও আফগানিস্তানে জঙ্গিবাদী হামলার জন্য সবরকমের মদদ জোগাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

পাকিস্তান মোটেই জঙ্গিবাদ দমনে আন্তরিক নয়। হাফিজদের গ্রেপ্তার করা আসলে পাকিস্তানি প্রতারণা মাত্র। আন্তর্জাতিক দুনিয়ার চোখে ধুলো দিতে চায় ইসলামাবাদ। তাই গত বছর ৭ নভেম্বর লাহোর হাইকোর্ট মুম্বাই হামলায় জড়িত অধ্যাপক মালিক জাফর ইকবাল, নাসরুল্লাহ, সামিউল্লাহ, ইয়াহিয়া মুজাহিদ, হাফিজ আব্দুল রহমান মক্কী এবং উমর বাহাদুরকে মুক্তি দেয়।

গত বছর নিউ ইয়র্কের আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স স্টার্ট-আপ 'ক্যাস্টেলাম'-এর রিপোর্ট অনুযায়ী পাকিস্তান তাদের সন্ত্রাসের নজরদারি তালিকা থেকে ৪ হাজার নাম বাদ দিয়েছে। এই ৪ হাজারের মধ্যে মুম্বাই হামলায় জড়িত জাকির উর রহমান লাখভী-র নামও রয়েছে। ২০১৮ সালে ৭ হাজার ৬০০ জনের নাম ছিল নজরদারির তালিকায়। কিন্তু নিষিদ্ধ ব্যক্তির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয় ১ হাজার ৬৯ জনের নাম। পরে আরও ৮০০ নাম বাদ যায়। শেষপর্যন্ত কমতে কমতে এসে দাঁড়ায় ৩৮০০ জনে। যুক্তরাষ্ট্র বা জাতিসংঘের তালিকাভুক্তদের নামও বাদ দেয় পাকিস্তান।

২০০৮ সালে মুম্বাই হামলায় জড়িত থাকায় যুক্তরাষ্ট্র হাফিজের মাথার দাম ১০ মিলিয়ন ডলার ঘোষণা করার পরও পাকিস্তানে বসে প্রকাশ্যে সাংবাদিক সম্মেলন করে সে পাল্টা চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। বলেছিল, 'পালিয়ে যাইনি। বা গর্তেও ঢুকিনি। দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনও বিচার ব্যবস্থার সম্মুখীন হতে কোনও আপত্তি নেই'। আসলে পাকিস্তান সরকার সবসময়ই আগলে রেখেছে হাফিজকে। তাই ইসলামাবাদের সুপারিশেই জঙ্গিবাদী কার্যকলাপে জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েও জাতিসংঘ তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফিরিয়ে দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্লের নৃশংস হত্যাকারী আল-কায়দার আহমেদ ওমর সাঈদ শেখও পাকিস্তানি সুপ্রিম কোর্ট থেকে রেহাই পেয়েছে। পাকিস্তানি সুপ্রিম কোর্ট ঘাতক ফাহাদ নাসিম আহমেদ, সৈয়দ সালমান সাকিব ও আদিলকেও মুক্তি দেয়। জইশ-ই-মোহাম্মদ-এর প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ মাসুদ আজহার আলভি পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মিরে দিব্যি নিজের জঙ্গিবাদী কার্যকলাপ ও সংগঠন চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ বিবিসি তাদের প্রতিবেদনে এই কুখ্যাত জঙ্গিবাদী সম্পর্কে বলেছিল, 'আলভিই ব্রিটেনে জিহাদ নিয়ে আসে'। ২০০৭ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান বলেছিল, মুজফ্ফরাবাদে জইশের ছাউনিতে তল্লাশি চালিয়ে পাকিস্তানি সেনা তাকে গ্রেপ্তার করেছে।

মাসুদ আজাহারকে নিয়েও একই নাটক করে চলেছে পাকিস্তান। ২০১৪ সালে তারা বলেছিল মাসুদ কোথায় সেটা নাকি তারা জানেই না। অথচ ২০১৬ সালে মুজফ্ফরাবাদে কাশ্মিরে জিহাদের ডাক দিয়ে মাসুদকে জনসভা করতে দেখা যায়। লাখভিও একইভাবে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে পাকিস্তানে।

জঙ্গিবাদীদের মদদের প্রশ্নে শুধু পাকিস্তানের প্রতিবেশী ভারতই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং ফ্রান্সও বহুবার আঙুল তুলেছে ইসলামাবাদের দিকে। ২০১৯ সালে তখনকার পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যুক্তরাষ্ট্রে সফরকালে স্বীকার করেছিলেন ৩০ থেকে ৪০ হাজার সশস্ত্র জঙ্গিবাদী তাদের দেশে রয়েছে। দায় চাপিয়েছিলেন পূর্বতন সরকারের কাঁধে। যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের প্রতিবেদন বলছে, লস্কর এবং জৈশদের ছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন সরকারি ছত্রছায়ায় এখনও সেখানে সমান সক্রিয়।

জাতিসংঘের তালিকাভুক্ত মাসুদ আজহার বা মুম্বাই হামলার পরিচালক সাজিদ মীর-এর মতো হাজার হাজার জঙ্গিবাদী পাকিস্তানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাকিস্তানের পাঞ্জাব পুলিশের রিপোর্ট বলছে, তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তান (টিএলপি)-সহ ৬৬৭ জন ঘোষিত জঙ্গিবাদীর তালিকা তাদের হাতে রয়েছে। কিন্তু সরকারের অনিচ্ছার কারণে তারা গ্রেপ্তার হচ্ছে না।

পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই সহানুভুতিশীল হয়ে তাদের মদদ দিচ্ছে। আল-কায়দা অনুমোদিত জৈইশ ভারতের কাশ্মিরে সক্রিয়। এফবিআই গোয়ান্দেরা উপগ্রহ চিত্র পর্যালোচনা করে বলেছে, বহু জঙ্গিবাদী সংগঠন পাকিস্তানে ঘাঁটি করে নিজেদের নাশকতামূলক কাজকর্ম চালাচ্ছে।

হাফিজ সাঈদের সাম্প্রতিক শাস্তি ঘোষণা আসলে পাকিস্তানি প্রতারণার একটি অঙ্গমাত্র, একথা নিশ্চিত করেই বলে দেওয়া যায়। জঙ্গিবাদীদের নরম মনোভাব তো বটেই, সেইসঙ্গে রাষ্ট্রীয় মদদকেও আড়াল করতে চাইছে দেশটি। একদিকে হাফিজকে শাস্তির কথা বলছে, অন্যদিকে জৈশ প্রকাশ্যে কাশ্মিরে জিহাদের প্রচার চালাচ্ছে। জঙ্গিবাদীরা সমানে নিয়োগ প্রক্রিয়াও চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের মুখোশ খুলে গিয়েছে। এফএটিএফ-এর ধুসর তালিকা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে জঙ্গিবাদীদের শাস্তি ঘোষণা পাকিস্তানের পুরোনো কৌশল। গতবারের মতোই এবারও তাই প্রতীকী গ্রেপ্তারেই জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে নিজেদের দায়সারা দায়িত্ব পালনের অভিনয় করছে পাকিস্তান।

লেখক: অনয় মুখার্জি, সাংবাদিক

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.