দ্বিতীয় পর্ব: নিশ্চিত জাহান্নামী যারা
- Details
- by এহসানুল কবীর
মহান আল্লাহ তা’লা বলেন, “আর (সেই দিন) শুভাকাঙ্খী শুভাকাঙ্খীর খবর নিবে না, তাদেরকে একে অপরের দৃষ্টিগোচর করা হবে। অপরাধী সেই দিনের শাস্তির বদলে চাইবে তার সন্তান-সন্তুতিকে, তার স্ত্রী ও ভাইকে তার জ্ঞাতি-গোষ্ঠীকে, যারা তাকে আশ্রয় দিত এবং পৃথিবীর সকলকে, যাতে এই মুক্তিপণ তাকে মুক্তি দেয়।
না কখনোই নয়, এটা লেলিহান আগুন, যা শরীর থেকে চামড়া খসিয়ে দিবে। জাহান্নাম সেই ব্যক্তিকে ডাকবে যে সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। যে সম্পদ পুঞ্জীভূত এবং সংরক্ষিত করে রেখেছিল।” (সূরা মা’আরিজ : ১০ - ১৮)
কুরআন মজীদের এই পংক্তিমালা আখিরাতের ভয়াবহ চিত্রের মধ্যে অন্যতম। দুনিয়ার জীবনে মানুষ তার পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, সুহৃদ-শুভাকাঙ্খীদের মধ্যে বসবাস করে। এক ধরনের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে নিজের চারিদিকে। কিয়ামতের সেইদিন এর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, প্রত্যেকে ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। দেখেও কেউ দেখবে না নিকটজনদের। এতেই যদি শেষ হতো তো কথা ছিল। বরং যখন সে নিজের সমূহ বিপদ উপলব্ধি করবে তখন সে স্ত্রী-পুত্র-পরিজন, পিতা-মাতা এমনকি সব মানুষের বিনিময়ে জাহান্নাম থেকে বাঁচতে চাইবে। অর্থাৎ এদের সবাইকে জাহান্নামে দিন প্রভু তবু আমায় মুক্তি দিন।
আজ এ দুনিয়ায় যাদের জন্য সে জীবন শেষ করছে, যাদের সুখ-সম্ভোগ আর খায়েশ মেটানোর জন্য সে আল্লাহকে চেনার, দ্বীনকে জানার, নিজের নাজাতের জন্য যৎসামান্য আমল করারও সময় পেল না কাল সে সব মায়ার বন্ধন শেষ হয়ে যাবে। পরিস্থিতির ভয়াবহতায় সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার স্বাভাবিক দয়া-মায়াটুকু উঠে যাবে। কি ভয়াবহ অবস্থা! কুরআন মজীদের একাধিক স্থানে এ চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। যেমন সূরা আবাসা ৮০: ৩৩-৩৭। কেন? যেন মানুষ সেই দিনের এই বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারে।
ওই দিন কিছু মানুষ কিন্তু এ অবস্থায় থাকবে না। তারা কেউ থাকবে আরসের ছায়ায় কেউবা পাবে ফিরিস্তাদের সিকিউরিটি প্রোটকল। মহান রব্বুল আলামীনের অতিথিদের জন্য তাঁর সুরক্ষা বলয়ের আশ্রয়ে থাকবে তারা। এই সৌভাগ্যবানদের বিষয়ে ইতিপূর্বে আমরা কিছু আলোকপাত করেছি। কিন্তু হযরত উমর (রা.) তার খতীবদের নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন কেবল জান্নাতের আলোচনা না করে, কেবল ঈমানের কথা না বলে। বিপরীত চিত্রটাও যেন তুলে ধরেন তারা, কারণ অন্ধকার না চিনলে আলো চেনা যায় না, আলোর মর্ম বুঝা যায় না। শিরক-কুফর-নাফরমানী সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে মানুষ অজান্তেই তাতে লিপ্ত হয়ে যায়। তাই গত কিস্তিতে আমরা শিরক সম্পর্কে কিঞ্চিত আলোকপাত করেছি। এ কিস্তিতে যে সব আমল মানুষকে আল্লাহর শাস্তির উপযুক্ত করে দেয় তার উপর সংক্ষেপে আলোকপাত করবো, ইনশা-আল্লাহ্। প্রকৃতপক্ষে ২টি কাজ মানুষকে জাহান্নামে যাওয়ার উপযুক্ত করে দেয়। তাহলো- আল্লাহ্ পাক
১. যা হুকুম দিয়েছেন তা না করা এবং
২. যা নিষেধ করেছেন তা করা।
আল্লাহ্ তা’লার মৌলিক হুকুম ও নিষেধগুলির একটা তালিকা আমরা পাই নিচের আয়াতসমূহে:
“বল, ‘আস, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য যা হারাম করেছেন তোমাদেরকে তা পাঠ করে শুনাই। তা এই- তোমরা তাঁর কোন শরীক করবে না, পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে, দারিদ্র্যের ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না, আমিই তোমাদের ও তাদেরকে রিযিক দিয়ে থাকি। প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে হোক অশ্লীল কাজের নিকটেও যাবে না। আল্লাহ্ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথাযথ কারণ ছাড়া তোমরা তাকে হত্যা করবে না।’ তোমাদেরকে তিনি এই নির্দেশ দিলেন যেন তোমরা অনুধাবন কর।
ইয়াতীম বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত উত্তম ব্যবস্থা ব্যতীত তোমরা তার সম্পত্তির নিকটবর্তী হবে না এবং মাপ ও ওজনে ন্যায্যভাবে পুরাপুরি দিবে। আমি কাউকেও তার সাধ্যাতীত ভার অর্পণ করি না। যখন তোমরা কথা বলবে তখন ন্যায্যভাবে বলবে, স্বজনের সম্পর্কে হলেও এবং আল্লাহকে দেয়া অঙ্গীকার পূর্ণ করবে। এইভাবে আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিলেন, যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।
আর এই পথই আমার সরল পথ। সুতরাং তোমরা এই পথেরই অনুসরণ করবে এবং বিভিন্ন পথ অনুসরণ করবে না, করলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ হতে বিচ্ছিন্ন করবে। এভাবে আল্লাহ্ তোমাদেরকে নির্দেশ দিলেন, যেন তোমরা সাবধান হও।” (সূরা আনআম ৬ : ১৫১-১৫৩)
নবী (স.) তার হাদীসে এ বিষয়গুলি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। জাহান্নামী হওয়ার আমলগুলি তুলে ধরে সে বিষয়ে আমাদের সাবধান করেছেন। নিম্নে তার কয়েকটি উল্লেখ করা হল।
নবী (স.) বলেন :
“তিন ধরনের মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। প্রথমত: যারা তাদের পিতা-মাতাকে যথাযথভাবে সম্মান করে না, দ্বিতীয়ত: যে তার স্ত্রীকে অপরের সাথে ব্যভিচারের অনুমতি দেয় এবং সেই নারী যার চলাফেরা পুরুষের মতো অথবা যার আচরণ ও চলাফেরায় পুরুষেরা আকৃষ্ট হয়।” (আত-তারগীব ওয়াত তারহীব)
তিনি (সা.) আরো বলেন
“যারা মদে আসক্ত থাকে, সুদ গ্রহণ করে এবং যারা পিতা-মাতার অবাধ্য হয় তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।” (মুসতাদরাকে হাকেম, আততারগীব ওয়াত তারহীব)
আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত হাদীসে রসূল (স.) বলেন:
তিন ব্যক্তির প্রতি কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ্ তা’লা রহমতের দৃষ্টিতে দেখবেন না। তারা হল-
- পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান,
- পুরুষের বেশধারী নারী এবং
- দাইয়ুস ব্যক্তি অর্থাৎ যারা স্ত্রী কন্যার অশ্লীল জীবন যাপনে ঘৃণা বোধ করে না।
আর তিন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। তারা হল-
- পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান
- মাদকাসক্ত ব্যক্তি এবং
- দানকৃত বস্তুর জন্য খোটা দানকারী
দাইয়ূস ব্যক্তির জন্য জান্নাত হারাম
দাইয়ুস বলা হয় এমন পুরুষকে যে তার স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের অশালীন জীবন-যাপনের সুযোগ দেয়। তারা অশ্লীলতা ও ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। আর ওই ব্যক্তি এ ব্যাপারে উদাসীন ও সহনশীল থাকে। রসূল (স.) বলেন:
“দাইয়ূস কখনোই জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” (নাসাই)
অনেকে ব্যক্তিগতভাবে নামায রোজা করেন। কিন্তু পরিবারে বেপর্দা জীবন যাপনের অনুমতি দেন। এমন ব্যক্তিদের জন্য এ রকম কঠিন পরিণাম অপেক্ষা করছে। মা-বোনেরা সতর্ক হোন। নিজেরা জাহান্নামী হচ্ছেন পরিবারের সদস্যদেরও জাহান্নামী করছেন।
মাদকাসক্ত ব্যক্তি
রসূল (স.) মদপানে নিষেধ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘এটি সব মন্দের চাবিকাঠি’। (ইবনে মাযাহ)
তিনি আরো বলেছেন, ‘নিয়মিত মদপানকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (ইবনে মাযাহ)
মাদক দ্রব্যের মধ্যে যা মানুষের সুস্থ চেতনা বিলোপ করে, তার সবই অন্তর্ভুক্ত। মদ, ইয়াবা, হিরোইন, গাজা-চরস, প্যাথেড্রিন সবই এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। আজকাল এনার্জি ড্রিংকের নামে যুব সমাজের মধ্যে মাদক সেবনের সম্প্রসারণ হচ্ছে। কেউ বলতে পারেন এতে অতি সামান্য পরিমাণে অ্যালকোহল আছে। রসূল (স.) বলেন, যা অধিক পরিমাণে হারাম তা অল্প পরিমাণেও হারাম।
হারাম উপার্জনকারীর জন্য জান্নাত নিষিদ্ধ
‘রসূল (স.) বলেন, হারাম খাদ্য দ্বারা পরিপুষ্ট শরীর জান্নাতে যাবে না।’ (মিশকাত)
এখন প্রশ্ন হল হারাম উপার্জনকারীর যদি এই পরিণাম হয় তাহলে যারা এই হারাম টাকার বিনিময়ে লোকদের জন্য দোয়া করছেন, তাদের সংশোধন হতে না বলে, তাওবার আহবান না জানিয়ে জান্নাতী হওয়ার জন্য তাদের জন্য দোয়া করছেন তাদের কি পরিণাম হবে? আর যারা এই সব সম্পদ দিয়ে মসজিদের চাকচিক্য ও জাঁকজমক বাড়াচ্ছেন, মাদ্রাসা বানাচ্ছেন তাদের অবস্থাই বা কি? তারা কি এই মানুষগুলোর অন্যায়ের ভাগীদার হচ্ছেন না? তাদের নাজাতের মিথ্যা আশা দিয়ে তাদের সাথে প্রতারণা করছেন না? নিজেদের বৈষয়িক লাভ ও নাম কামানোর জন্য এই মানুষগুলোকে তাওবার পথ থেকে ফিরিয়ে রাখছেন না? বরং তাদেরকে তওবার দিকে আহবান জানানোই তো উচিত ছিল। তাদের এ অবৈধ সম্পদ নিজের জন্য ও আল্লাহর ঘরের জন্য গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালেই তো তারা এই আত্মপ্রতারণা হতে বের হয়ে আসার তাগিদ পেত।
তারা ভাবছে, এভাবে একদিকে হারাম কামাই করে দান-সাদাকা করে বা মসজিদ গড়ে তারা আল্লাহর ক্ষমা পেয়ে যাবে। অথচ রসূল (স.) বলেন “আল্লাহ্ পবিত্র, তিনি কেবল পবিত্র বস্তুই গ্রহণ করেন।” (মুসলিম) এ দীর্ঘ হাদীসে রসূল (স.) এক ব্যক্তির কথা বলেছেন যে, ক্লান্ত-শ্রান্ত, ধুলি-ধূসিরত দেহে আল্লাহকে ডাকছে। অথচ তার দেহ, পরিধেয় বস্ত্র সবই হারাম মালে গঠিত। হাদীস ব্যাখ্যাকারীরা এই লোকের বর্ণনায় অনুমান করেছেন সম্ভবত: সে হজ্জের সময় আরাফাতে বসে দোয়া করছে। হাদীসে তার ও তার পোশাক-আশাকের বর্ণনায় এমনটিই মনে হয়। অর্থাৎ আরাফাতের ময়দানেও তার দোয়া কবুল হবে না। কারণ তার সকল কিছুই হারাম সম্পদের দারা গঠিত।
অপরের হক নষ্টকারীর পরিণাম
রসূলুল্লাহ্ (স.) বলেন-
“যে ব্যক্তি মিথ্যা কসম খেয়ে কোনো মুসলিমের হক মেরে দেবে তার জন্য আল্লাহ তা’লা জাহান্নাম ওয়াজিব ও জান্নাত হারাম করে দিবেন। এক ব্যক্তি বললো, যদি তা নগণ্য জিনিস হয়, হে আল্লাহর রসূল! তিনি (স.) বললেন, যদি তা গাছের সামান্য একটা ডালও হয় তা হলে তার জন্য একই কথা প্রযোজ্য।” (মুসলিম)
তা হলে আজ যারা ব্যাংক থেকে, শেয়ার মার্কেট থেকে জনগণের শত শত হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে তাদের কি পরিণাম হবে? যারা ওয়ারিশদের সম্পদ মেরে দিচ্ছে? যারা অপরের জমি দখল করছে, ডেভেলাপ করছে? দেশে-বিদেশে এই হারাম দিয়ে সম্পদ গড়ছে বেগম পাড়ায়, জ্যাকসন হাইটসে, মালয়েশিয়ায়, সিঙ্গাপুরে?
প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজ কর্মের দায়ে আবদ্ধ। মানুষ গুনাহ করে লোভের বসে, নাফসানিয়াতের তাড়নায়। তাওবার সুযোগ কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। হারামের উপর বসে, হারামে আয়েশ করে, হারাম মাল সাদাকা করে, তা দিয়ে হাজ্জ ওমরা করে বা মসজিদ বানিয়ে তাওবা হবে না। এর পথ ভিন্ন। হকদারদের হক ফিরিয়ে দিতে হবে। তাদের কষ্টের জন্য মাফ চেয়ে নিতে হবে। তাদের না পেলে সে মাল তাদের পক্ষ থেকে সাদাকা করে দিতে হবে। আন্তরিকভাবে তাওবা করতে হবে আল্লাহর দরবারে। ওই বান্দা-বান্দীদের জন্য দোয়া করতে হবে। যেন কাল কিয়ামতের দিন তারা দাবী না রাখে। বিষয়টা অবশ্যই কষ্টের। তবে জাহান্নামের আযাবের তুলনায় তা কিছুই নয়।
তাওবার মহা সময় অতিক্রান্ত হচ্ছে। শবে কদরের অন্বেষণে বেশী সময় দেই। গুনাহ খাতার জন্য মাফ চাই মহান রবের নিকট। হে আল্লাহ্ আমাদের ক্ষমা করুন। আমরা গুনাহগার আমাদের তাওবা কবুল করুন। হিম্মত দিন, সাহস দিন, তাওবার পথকে সহজ করে দিন, ইয়া রব্বাল আলামীন।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.