সাবেকুনদের অন্তর্ভুক্ত হই
- Details
- by এহসানুল কবীর
মহান আল্লাহ তা’লা বলেন, ‘আর (সেদিন) তোমরা বিভক্ত হয়ে পড়বে তিন শ্রেণিতে- ডান দিকের দল; কত ভাগ্যবান ডান দিকের দল! বাম দিকের দল; কত হতভাগ্য বাম দিকের দল! আর সাবেকুন (তথা অগ্রগামীরাই) তো অগ্রগামী, তারাই তো নৈকট্য লাভকারী।’ (সূরা ওয়াকিয়া ৫৬: ৭-১১)।
কিয়ামতের দিন মানবজাতি ৩টি মূল শ্রেণিতে ভাগ হয়ে যাবে:
১. ডান দিকের মানুষ- যারা ঈমানদার নেক আমলকারী
২. বাম দিকের মানুষ- যারা কাফির মুশরিক, মুনাফিক, আল্লাহর নাফরমান পাপীরা
৩. সাবেকুন বা অগ্রবর্তীরা
সাবেকুন বা অগ্রবর্তীরা: যারা নেক আমলে অগ্রসর, সৎ কাজ দ্রুত সম্পাদনকারী, অসৎ কাজ থেকে নিজেকে হিফাজতকারী। হাদীসে রসূল (স.)-এর ভাষায় তারা হল সেই সব লোক যাদের সামনে যখন হককে উপস্থাপন করা হয় তারা অবিলম্বে তা গ্রহণ করে; যখন তাদের কাছে কোনো হক বা অধিকার দাবি করা হয়, তখন সর্বোচ্চ সুন্দরভাবে তারা তা আদায় করে এবং অপরের জন্য তারা তা-ই পছন্দ করে যা তারা নিজেদের জন্য করে। (মুসনাদে আহমদ)
এই অগ্রবর্তী মানুষদের একটি তালিকা আমরা পাই নবী (স.)-এর অপর এক হাদীসে। কিয়ামতের দিন যখন সমস্ত মানুষ চরম বিপর্যস্ত, তখন ৭ শ্রেণির মানুষ মহান আল্লাহ্ রব্বুল আ’লামীনের আরশের ছায়ায় অবস্থান করবেন। তারা হলেন:
১. ন্যায়পরায়ণ শাসক
২. সেই যুবক যে আল্লাহর ইবাদাতের মধ্যে বড় হয়েছে
৩. সেই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সাথে লেগে আছে
৪. ওই দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর জন্যই পরস্পরকে ভালবাসে ও একত্র হয় এবং আল্লাহর জন্যই পরস্পরের থেকে পৃথক হয়
৫. সেই ব্যক্তি যাকে কোনো সুন্দরী উচ্চ বংশীয়া নারী অবৈধ সম্পর্কের জন্য আহবান জানালে সে তা প্রত্যাখ্যান করে এই বলে যে, ‘আমি আল্লাহ্কে ভয় করি’
৬. সেই ব্যক্তি যে এমন গোপনীয়তার সাথে দান করে যে তার বাঁ হাত জানে না- ডান হাত কি দান করেছে। এবং
৭. সেই ব্যক্তি, যে তার একান্তে আল্লাহ্কে স্মরণ করে এবং আল্লাহর ভয়ে সে অশ্রু বিসর্জন করে। (বুখারী, মুসলিম)
হাদীসের শিক্ষণীয়
(১) ন্যায়পরায়ণ শাসক সমাজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ: এই বিষয়টি রসুল (সা.) বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন। তবে প্রত্যেকবারই ন্যায়পরায়ণ শাসকের কথা সবার আগে উল্লেখ করেছেন।
এতে বুঝা যায়, ন্যায়পরায়ণ শাসক একটা সুষ্ঠু সুন্দর সমাজের বিকাশের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত: একজন ন্যায়পরায়ণ শাসকের অধীনে বাকি সমাজে ৬ ধরনের লোকের বিকাশ-বিস্তৃতি ঘটে। সেজন্য অনুকূল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এ রকম অনুকূল পরিবেশে যুবকরা দ্বীনদারীর মধ্যে বেড়ে উঠার সুযোগ পায়। ফলে তাদের অন্তরগুলো মসজিদের সাথে লেগে থাকে। তারা নিয়মিত মসজিদে যায়, ফলে নেকদিল মানুষগুলো একে অন্যকে আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবাসতে শুরু করে। সমাজে ভাতৃত্বের সুবাতাস বইতে থাকে। তারা কল্যাণকর কাজে পরস্পরকে সহায়তা করে। এক কল্যাণকর কাজের জন্য আল্লাহর ওয়াস্তে মিলিত হয়। আবার আরেক নেক কাজের স্বার্থে পরস্পর থেকে পৃথক হয়।
এমনি পরিবেশেই মানুষের মধ্যে পবিত্র চিন্তাধারাগুলো বিকাশ লাভ করে। তারা গোপন প্রকাশ্য সব অবস্থাতেই আল্লাহকে ভয় করে। ফলে কোনো সুন্দরী নারীর অবৈধ আহবানকে সহজেই প্রত্যাখ্যান করতে পারে। সমাজে ন্যায় ও কল্যাণের এই বিস্তৃতিতেই সম্পদশালী মানুষেরা নিজেদের নাজাতের জন্য গোপনে দান করে। ফরয দান-সাদাকার সাথে সাথে নফল কাজগুলি একান্তে সম্পাদন করে, যাতে আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ তা জানতে না পারে। আর সমাজের সর্বস্তরে কল্যাণ ও নেকীর ভাবধারার এই সুবিস্তৃতি মানুষের মধ্যে আল্লাহ্ সম্পর্কে তাঁর প্রতি নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে। অন্যদের সৎ গুণাবলী ও সৎ কাজগুলির মোকাবেলায় নিজেকে নিতান্তই ক্ষুদ্র ও অকিঞ্চিতকর মনে হয়। ফলে নিজের অক্ষমতা ও কমতির জন্য একান্তে চোখের পানি ফেলে আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করে। তাঁর নিকট তাওফীক প্রার্থনা করে।
ন্যায়পরায়ণ শাসক তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটা সুষ্ঠু-সুন্দর কল্যাণময় সমাজ গড়ার অপরিহার্য উপাদান। হাদীসে রসুল (সা.)-এ বলা হয়েছে-
‘তোমাদের সর্বোৎকৃষ্ট শাসকবৃন্দ হল তারা, যাদেরকে তোমরা ভালবাস এবং তারাও তোমাদেরকে ভালবাসে। তোমরা তাদের জন্য দুআ কর এবং তারাও তোমাদের জন্য দুআ করে। আর তোমাদের নিকৃষ্টতম শাসকবৃন্দ তারা যাদেরকে তোমরা ঘৃণা কর এবং তারাও তোমাদেরকে ঘৃণা করে। তোমরা তাদেরকে অভিশাপ দাও এবং তারাও তোমাদেরকে অভিশাপ দেয়।’ (মুসলিম শরীফ)
দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমান সময় প্রায় সর্বত্রই আমরা এই দ্বিতীয় শ্রেণির শাসকই দেখতে পাই। এদের প্রতি রসুলুল্লাহ্ (সা.) অভিশাপ দিয়েছেন:
‘হে আল্লাহ্! যে কেউ আমার উম্মতের কোনো কাজের কিছু দায়িত্ব নিয়ে তাদের কষ্টে ফেলবে, তুমি তাকে কষ্টে ফেলো। আর যে কেউ আমার উম্মতের কোনো কাজের কোনো দায়িত্ব নিয়ে তাদের সাথে নম্রতা অবলম্বন করবে, তুমিও তার সাথে নম্রতা অবলম্বন কর।’ (মুসলিম শরীফ)
রসুল (সা.) আরো বলেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তি মুসলিম জনগণের শাসক নিযুক্ত হয় অতঃপর সে প্রতারক বা আত্মসাৎকারীরূপে মৃত্যুবরণ করে, আল্লাহ্ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন।’ (বুখারী-মুসলিম)
হযরত উমর (রা.) বলেন- ‘কিয়ামতের দিন সহনশীল ন্যায়পরায়ণ শাসকই হবে আল্লাহর কাছে সমস্ত বান্দার চেয়ে উত্তম মর্যাদার অধিকারী। আর কিয়ামতের দিন নিষ্ঠুর অত্যাচারী শাসকরাই হবে আল্লাহর কাছে সমস্ত মানুষের চেয়ে নিকৃষ্ট।’ (মিশকাত)
(২) কিয়ামতের দিন আরশের ছায়ায় আশ্রয় লাভকারী ৭ শ্রেণির প্রথম ৪ জনের বিষয় প্রকাশ্য। যথা- ন্যায়পরায়ণ শাসক, নেক স্বভাবের যুবক, মসজিদে যাতায়াতকারী ব্যক্তি ও সেই ২ ব্যক্তি যারা আল্লাহর ওয়াস্তে পরস্পরের সাথে সম্পর্ক রাখে ও মিলিত হয়। আবার পরবর্তী ৩ শ্রেণির বিষয়টি গোপনীয় যথা- অবৈধ যৌনাচার থেকে আত্মরক্ষাকারী, একান্ত গোপনে দানকারী এবং নিভৃতে আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনকারী।
এতে বুঝা যায়, মানুষের সামষ্টিক কাজগুলি যেমন আল্লাহর ওয়াস্তে করতে হবে; তাঁর প্রতি আনুগত্যশীল হতে হবে, তেমনি একান্ত জীবনে আল্লাহমুখী জীবনযাপন করতে হবে, আল্লাহকে পরোয়া করে জীবন যাপন করতে হবে।
(৩) প্রশ্ন উঠতে পারে, সমাজে ন্যায়পরায়ণ শাসক না থাকলে বাকী শ্রেণিগুলির কি অন্তর্ভুক্ত হওয়া যাবে না? উত্তর হল- ন্যায়পরায়ণ শাসক কল্যাণময় সমাজ গড়ার গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক। তার অবর্তমানে বাকীদের নিজেদের নাজাতের জন্য এবং একটা সুন্দর সমাজ গড়ার জন্য অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে তাদের মর্তবা বাড়বে বই কমবে না। রসুল (সা.) প্রতিকূল পরিবেশে দ্বীনের উপর চলনেওয়ালা ও দ্বীনের পথে প্রচেষ্টাকারীদের সুসংবাদ দান করেছেন।
(৪) একটা কল্যাণময় সমাজ গড়ার জন্য এই ৭ শ্রেণির মানুষ যথেষ্ট সংখ্যক থাকা জরুরি। এরূপ যোগ্যতাগুলি নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি করা এবং সে অনুযায়ী পরিবার, প্রতিষ্ঠান ও সমাজ গড়ার জন্য মুমিনদের অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
(৫) সার্বিক গুণে গুণান্বিতরা: এই ৭ শ্রেণির মানুষের গুণ বৈশিষ্ট্যগুলি কি কোনো মানুষের মধ্যে একত্রিত হয়েছে? প্রথমত আম্বিয়া (আ.) মানবজাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান এবং তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম অবস্থান হল রসুলুল্লাহ্ (সা.)-এর। নবী (আ.) দের মধ্যে ইউসুফ (আ.)-কেই আমরা সবগুলি অবস্থার মধ্যে পাই। উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্যে হযরত উমর (রা.)-এর মধ্যেও আমরা এ ৭ ধরনের গুণের অনেকগুলির সমাবেশ দেখতে পাই। যেমন- ন্যায়পরায়ণ শাসক, গোপনে প্রজা হিতৈষী ভূমিকা পালন- যাতে তার কাঁধে মাল বহনের দাগ পড়ে গিয়েছিল এবং আল্লাহর ভয়ে তিনি এত পরিমাণ কান্নাকাটি করতেন যে তার চোখের নিচে দাগ পড়ে যায়।
বস্তুত: নবী (সা.) এর সাহাবীদের অনেকের মধ্যেই উল্লিখিত গুণগুলির একাধিক আমরা দেখতে পাই। আর এদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম অবস্থান প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.)-এর। যার সম্পর্কে রসুলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন যে, জান্নাতের ৮টি দরজার সবগুলি থেকেই তাকে আহবান করা হবে। রসুল (সা.)-এর তালিমে এক বিপুল পরিমাণ নেক ও পবিত্র চরিত্রের মানুষ তৈরি হয় সাহাবীদের (রা.)-মধ্যে। তাই এটি পৃথিবীর স্বর্ণযুগ হিসেবে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছে।
সর্বশেষ কথা হল এই ৭ শ্রেণির মধ্যে স্থান করে নেওয়ার সুযোগ আজও অবারিত। আর এর মধ্যে সর্বশেষ বৈশিষ্ট্যটি সবার জন্য উন্মুক্ত: আল্লাহকে একান্তে স্মরণ করা এবং তাঁর নিকট জবাবদিহির ভয়ে একান্তে কান্নাকাটি করা। বিশেষত: চলমান সময় রমজান মাস আমাদের সবার জন্য এর এক অনুপম সুযোগ এনে দিয়েছে। আসুন, সবাই এ গুণ অর্জন করি। চোখের পানি ফেলে তারাবী-তাহাজ্জুদে, দোয়ায়-মোনাজাতে আল্লাহর নিকট গুনাহর জন্য মাফ চাই এবং আল্লাহর অগ্রবর্তী বান্দা তথা সাবেকুনদের মধ্যে যেন আমাদের তিনি শামিল করে নেন তার জন্য দোয়া করি।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.