আপনি পড়ছেন

আল্লাহ তা’লা বলেন, ‘আমি জিন্ন ও মানুষকে শুধুমাত্র আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা যারিয়াত ৫১:৫৬)। আয়াতখানি বহুল ব্যবহৃত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর তাৎপর্য উপলব্ধি করা হয়েছে খুবই কম। এমনকি দ্বীনি মহলেও এর উদ্দেশ্য যথাযথ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না।

human aquintance prayersপ্রতীকী ছবি

মহান আল্লাহ তা’লা বললেন, তিনি মানুষ ও জিন্ন জাতি সৃষ্টিই করেছেন শুধু তাঁর ইবাদতের জন্য। জিন্ন জাতির আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। তাই আমরা অর্থাৎ মানুষের বেলায় এ আয়াতের দাবি বুঝে দেখার চেষ্টা করবো।

আমরা ধরেই নিয়েছি ইবাদত বলতে এখানে শুধু আনুষ্ঠানিক ইবাদাতসমূহ যেমন নামায-রোজাকে বুঝানো হয়েছে। প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা সময়। ৫ ওয়াক্ত নামাযে আমরা ব্যয় করি ধরুন, এস্তেঞ্জা-ওজুসহ বড়জোর ২ ঘণ্টা। একইভাবে রমজানের রোজা রাখি এক মাস। হজ্জ জীবনে একবার। যাকাত বছরে একবার সে-ও যার নির্দিষ্ট সম্পদ আছে তাকে দিতে হয়। তাও মাত্র ২.৫% হারে। তাহলে জীবনের বাকি সময় ও বাকি সম্পদের ব্যবহার কি আমাদের স্বেচ্ছাধীন? যা ইচ্ছা তাই করার অধিকার রাখি আমরা?

অথচ আয়াতে বলা হল শুধুমাত্র আল্লাহ তা’লার ইবাদতের জন্যই আমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষের কাজ শুধুই ইবাদত করা, অন্য কিছু না। আর মানুষ সারাদিন নামায পড়ে না, সারা বছর রোজা রাখে না। আল্লাহ তা’লা তাঁর পাক কালামে এমন নির্দেশ দেননি। মানুষজাতিকে দ্বীন শিক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি নবী (স.)-কে পাঠিয়েছেন। তিনিও তা শিক্ষা দেননি। অতএব, শুধুই আনুষ্ঠানিক কিছু কাজ করার মধ্যেই ইবাদত সীমাবদ্ধ এই ধারণার (Concept) মধ্যে গুরুতর (Serious) ত্রুটি রয়েছে।

নামায-রোজা করাও যেমন ইবাদত, না করাও ইবাদত

বিষয়টা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এভাবে চিন্তা করি না। ৫ ওয়াক্ত নামায পড়া যেমন আল্লাহর বিধান তেমনি ঠিক সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় নামায না পড়াও তাঁরই নির্দেশ। রমজানের রোজা রাখা ফরয, কিন্তু ঈদের দিনগুলিতে রোজা রাখা নিষিদ্ধ। তাহলে কি দাঁড়াল? অনুষ্ঠানগুলি নয়। আল্লাহর নির্দেশ তাঁর রসুলের সুন্নাহ অনুযায়ী পালনই ইবাদাত।

মানুষ শুধুই আল্লাহর বান্দা

মানুষ গোটা জীবনে সব কাজে, সব সময় শুধুই আল্লাহকে মেনে চলবে। সে শুধুই আল্লাহর বান্দা। বান্দা বা গোলামের কাজ কেবল বন্দেগী করা। গোলামী করা। কেবল নামায পড়ার সময় সে আল্লাহর বান্দা আর বাকি সময় সে যা ইচ্ছা তাই করবে এজন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়নি। রমজানের এক মাস কয়েকটা কাজে খুব আল্লাহ্কে মেনে চলবে আর বাকি বছর বাকি বিষয়ে সে যেমন খুশি তেমন চলবে এই ম্যানডেট বা নির্দেশনা তাকে দেওয়া হয়নি।

তাহলে নামায-রোজা কিসের জন্য?

প্রশ্ন তবে নামাজ-রোজার উদ্দেশ্য কি? নামায-রোজার বহুমাত্রিক উপকারিতা রয়েছে। আল্লাহ তা’লার প্রতি আনুষ্ঠানিক আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশসহ বহুবিধ উদ্দেশ্য রয়েছে এর মধ্যে। তবে অন্যতম হল বান্দার মধ্যে বন্দেগীর অনুভূতি সৃষ্টি করা এবং বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে বন্দেগীতে অভ্যস্ত করা।

মানুষ কোনো সৃষ্টির গোলাম নয়। সৃষ্টিকর্তা ছাড়া তার আর কোনো প্রভু নেই। যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন, তার রিজিক দিচ্ছেন, তার দুনিয়া-আখিরাতের যাবতীয় বিষয় যাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন, মানুষ শুধুমাত্র তাঁকেই প্রভু মানবে। তাঁর কথা মতোই সে চলবে। এটাই সবচেয়ে যৌক্তিক কথা। এর বিপরীত সমস্ত চিন্তাধারা যাবতীয় নীতি-ন্যায্যতার সম্পূর্ণ বরখেলাফ। তাত্ত্বিকভাবে এটা মেনে নেওয়া যত সহজ, বাস্তব জীবনে তা অনুসরণ ততটাই কঠিন।

অন্যের গোলামী থেকে মুক্ত হতে হলে সবার আগে নিজের গোলামী থেকে মুক্ত হওয়া জরুরি

মানুষকে বলা হয় বহুমুখী সম্ভাবনাসহ এক জটিল সত্ত্বা। সৃষ্টিকর্তা তাকে পরীক্ষার জন্য দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। তার মধ্যে একদিকে যেমন রয়েছে বিবেক ও মনুষ্যত্বের উন্নত বৈশিষ্ট্য তেমনি রয়েছে প্রবৃত্তির নানা প্রবণতা। যা তাকে পশুত্বের স্তরে নামিয়ে আনতে চায়। প্রবৃত্তিকে লাগামহীন চলতে দিলে সে মানুষের প্রভু হয়ে বসে।

‘তুমি কি তাকে দেখনি যে তার প্রবৃত্তির কামনা-বাসনাকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করেছে?’ (সূরা ফুরকান ২৫:৪৩)

মানুষের প্রবৃত্তি আবার তার ইলাহ হয়ে বসে কিভাবে? যখন সে প্রবৃত্তির খায়েশকেই নিজের জন্য একমাত্র নির্দেশক হিসেবে গ্রহণ করে, মনে যা চায় তা-ই করে, তা-ই খায়, তা-ই নেয়। বৈধ-অবৈধ পরোয়া করে না। অন্যের অধিকারের পরোয়া করে না। অন্যের দুর্বলতাকে নিজের জন্য সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। ত্রাণের টিন মেরে দেয়। ব্যাংক থেকে মানুষের গচ্ছিত সম্পদ ঋণ নিয়ে হজম করে ফেলে, কোনো মানুষের প্রভু হয়ে বসার জন্য যেন-তেনভাবে ক্ষমতা দখল করতে চায়। এর জন্য মানুষের জীবন-জীবিকার পরোয়া করে না। একজনের, বহুজনের, লাখো কোটি মানুষের-জীবন ধ্বংস হোক-আমার ক্ষমতা নিশ্চিত চাই।

ইরাক থেকে ইউক্রেন এই যুদ্ধের একই লক্ষ্য। বুশ-পুতিন থেকে শ্রীলঙ্কার রাজাপাকশে পরিবার বা আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সবার একই মনোভাব। এভাবে প্রবৃত্তি মানুষের প্রভু হয়ে বসে-ইলাহ বনে যায়। শুধু যে ক্ষমতাবানেরা এই রোগে আক্রান্ত তা-ই নয়। আমরা সাধারণ মানুষেরা কি শিক্ষিত কি মূর্খ যে-ই মনে যা চায় তাই করি বা করতে চাই এই মানসিকতা লালন করি, সে-ই প্রবৃত্তির দাস বনে যাই। সাধারণ মানুষের একটাই সমস্যা যা ইচ্ছা তা করার ক্ষমতা তার থাকে না। কিন্তু যদি পায়, যখন পায়, তখন প্রবৃত্তির খায়েশ পূরণে হেন কাজ নাই করে না।

এই মানসিকতা যে অসুস্থ, মানুষের নিজের জন্য, সমাজের জন্য, বিশ্বের জন্য ক্ষতিকর তাতে যে কেউই একমত হব। কিন্তু এর থেকে বাঁচার উপায় কি?

সৃষ্টিকর্তার গোলামীর চেতনা সৃষ্টিতে ইবাদাতের ভূমিকা

মানুষের নাফসের স্বাভাবিক প্রবণতাই হল সে মানুষের প্রভু হয়ে বসতে চায়। মানব সত্ত্বার উপরে ফেরাউনি শাসন কায়েম করতে চায়। মানব প্রবৃত্তি এক একটি বাচ্চা ফেরাউনের মতো। তাকে বাড়তে দিলে সে মানুষের মালিক-মোখতার বনে যায়। তাকে দিয়ে যা খুশি করাতে চায়। আনুষ্ঠানিক ইবাদাত-বন্দেগীগুলি মানুষের প্রবৃত্তির উপরে লাগাম পড়ায়। রোজার মাস। আমরা এক্ষেত্রে রোজার উপকারিতা নিয়েই চিন্তা করি। আসুন চিন্তা করি। আমাদের চিন্তা করতে বলা হয়েছে।

‘তারা কি কুরআন নিয়ে, কুরআনী বিধি ব্যবস্থা, কুরআনী চিন্তা-দর্শন নিয়ে চিন্তা করে না?’ (সুরা নিসা ৪:৮২)

চিন্তা-ভাবনা জ্ঞান-গবেষণা ছাড়া অন্ধের মতো ধর্মের বিধান মানার নির্দেশ দেয় মানুষের বানানো ধর্ম আর মতবাদগুলি। কারণ তাতে তাদের অসারতা যে উলঙ্গ হয়ে বেড়িয়ে আসবে। আল্লাহর সেই পরোয়া নেই। তিনি সত্য বিধান দিয়েছেন। কল্যাণের পথ দেখিয়েছেন। যত চিন্তা-ভাবনা করা হবে ততই তার কল্যাণকামিতা প্রকাশ পাবে। নতুন নতুন উপকারিতা উন্মোচিত হবে। উন্মোচিত হচ্ছে।

আমরা রোজা নিয়ে কথা বলছিলাম। রোজা দেখুন কিভাবে নফস বা প্রবৃত্তির স্বেচ্ছাচারিতার উপর নিয়ন্ত্রণ ও সংযমের লাগাম পড়িয়ে দেয়। সুবহে সাদিক হচ্ছে তো খাওয়া বন্ধ করো, সূর্যাস্ত হল তো অবশ্যই কিছু খাও। একঢোক পানি বা একটা খেজুর খাও। রোজা ভাঙো। তোমার মালিকের নির্দেশ। আবার সারাদিনের রোজা ও কাজের সম্মিলনে দেহ-মনে যে ক্লান্তি তার জন্য ঘুমিয়ে রাত পার করো না। রাতে অন্য সময়ের চেয়ে বাড়তি কিছু ইবাদত করো। শেষ রাতে অবশ্যই সেহরি খাও। সারাদিন কথায় ও কাজে সংযমী হও। রোজা ভেঙে ফেলে বা দুর্বল করে দেয় এমন কাজ মোটেই করো না।

এভাবে রোজা সৃষ্টি করে উবুদিয়াত। আল্লাহর গোলামীর অনুভূতি, মানসিকতা ও যোগ্যতা। সে শেখায় তোমার একজন প্রভু আছে। তুমি স্বাধীন নও। তিনি এ মাসে নিয়ম করেছেন দিনের বেলা খাওয়া যাবে না। রাতের বেলা ইবাদতে কাটাতে হবে, আয়েশ করা যাবে না। প্রভুর নির্দেশ মানতে হবে। সচেতনভাবে সতর্কতার সাথে প্রকাশ্যে ও গোপনে। কোনোভাবেই রোজা নষ্ট হয় এমন কাজ করা যাবে না।

শুধু রোজায় নয় এ মাফিক চলতে হবে গোটা জীবন। সবকাজে, সর্বক্ষেত্রে।

বস্তুত মানব সত্ত্বার বৈশিষ্ট্যই হল- অতিরিক্ত ও লাগাম ছাড়া খাদ্য গ্রহণ ও ভোগবিলাস নফসানিয়াত বা পশু প্রবৃত্তিকে প্রবল করে তোলে। অন্যদিকে ক্ষুধার যন্ত্রণায় নফস অবশ ও কাহিল হয়ে পড়ে। বিবেক জাগ্রত হয়। নফসকে নিয়ন্ত্রণে রোজার ভূমিকা তাই অতুলনীয়। অন্য সময় যে মানুষ পরবর্তী বেলায় কি খাবে সে ভেবে কাতর থাকে। রোজায় সে ওই বেলাগুলি অবলিলায় অভুক্ত কাটিয়ে দেয়। সত্যি-সত্যিই কিন্তু, তাত্ত্বিক কথা নয়। কিছু মানুষের সারাদিনের একটা গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা ও পেরেশানি পরের বেলায় তারা কি খাবে? কোথায় খাবে? এটা যে কত ফালতু ও মনুষ্যত্ব বিবর্জিত কথা তা রোজা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

ক্ষুধার যন্ত্রণা তখন মানুষের সামনে উন্মোচিত করে তার মত আরো কোটি কোটি মানুষের কথা যাদের ৩ বেলা দূরের কথা, এক বেলা এমনকি কখনো ইফতারের উপযুক্ত পরিষ্কার পানিটুকুও ঠিকমতো থাকে না। মনুষ্যত্বের উন্মোচনের জন্য মহান আল্লাহর এক অপূর্ব ব্যবস্থা এই রোজা। কিন্তু তা তো কেবল তাদের জন্য যারা তাঁর গোলামী কবুল করে নিয়েছে। মুমিনদের কাতারে নাম লিখিয়েছে-

‘হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য রোজার বিধান দেওয়া হল। যে বিধান দেওয়া হয়েছিল তোমাদের আগেরকার লোকদের, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার (পরহেজগার হতে পার, সত্যিকার মানুষ হতে পার।)’ (বাকারাঃ ১৮৩)

আমরা মুমিন। ইসলামে বিশ্বাসী। আসুন সত্যিকার অর্থে ঈমানের দাবি পূরণে অগ্রসর হই। আল্লাহ পাকের সত্যিকার বান্দা হিসেবে নিজেদের পরিচয়কে বাস্তব করে তুলি। আমি কেবল আমার স্রষ্টারই বান্দা, আমার নফসের বা অপর কারো নফসের নয়। ইসলাম এসেছেই মানুষকে মানুষের গোলামী থেকে মুক্ত করে শুধুমাত্র বিশ্ব জাহানের প্রকৃত মালিক সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা’লার গোলামে পরিণত করতে। নামায রোজা এই চেতনারই বাস্তব অনুশীলন। আসুন সচেতনভাবে রোজা রাখি। নিজেকে আল্লাহর বান্দা বা বান্দী হিসেবে গড়ে তুলি। মহান আল্লাহ তা’লা আমাদের সকলকে সেই তাওফীক দান করুন। আমিন।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.