কিছু কিছু জীবনের দাম অন্যদের চেয়ে বেশি!
- Details
- by ভিন্নমত
কিছু কিছু জীবনের দাম অন্যদের চেয়ে বেশি। ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমা মিডিয়ার কভারেজ দেখলে এটাই মনে হয়। এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, পাশ্চাত্যের বিভিন্ন মিডিয়া হাউস থেকে যেসব সাংবাদিককে যুদ্ধের খবর সংগ্রহে ইউক্রেনে পাঠানো হয়েছে, তাদের বিরাট অংশই শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টানদের জীবনকে বিশ্বের অন্যান্য বর্ণের ও ধর্মের মানুষের জীবনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান মনে করে।
প্রতিটি জীবনই অমূল্য। কিন্তু পশ্চিমা মিডিয়ায় কর্মরত সাংবাদিকদের অনেকে মনে করেন ইথিওপীয়, সোমালিয়ান, সুদানিজ, ইয়েমেনি, সিরিয়ান, আফগান, লিবিয়ান, ইরাকি এবং অতি অবশ্যই ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ ও মৃত্যুর চেয়ে শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টানদের দুর্ভোগ ও মৃত্যু বিশ্ববাসীর অধিকতর মনোযোগ দাবি করে।
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি থেকে শুরু করে পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের মিডিয়া হাউসগুলোর হর্তাকর্তা ও কর্মীদের সবার না হলেও অনেকের মনেই এ ধারণা গভীরভাবে গেঁথে আছে যে কিছু মানুষের জীবন অন্যদের তুলনায় সত্যিই বেশি মূল্যবান। প্রভাবশালী পশ্চিমা মিডিয়াগুলোর সম্পাদকীয় নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গী এমন যে প্রকারান্তরে প্রতিষ্ঠানের সব কর্মীই বুঝে যান, কারা এবং কোন ধরনের ভিকটিম সমবেদনা ও মনোযোগের দাবিদার। আর কাদের সেটা প্রাপ্য নয়।
এজন্যই দেখা যায়, পশ্চিমা শক্তিগুলো শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় অধ্যুষিত কোনো দেশ দখল করলে ট্র্যাজেডি, আত্মত্যাগ, বীরত্ব আর যুদ্ধের বিভীষিকার গল্প সামনে তুলে আনা হয়। অন্যদিকে, পশ্চিমা দেশগুলো যখন কোনো মুসলিম অধ্যুষিত দেশ দখল করে তখন ‘এমবেডেড’ তকমাধারী একদল রিপোর্টার সেখানে যায় মূলতঃ স্টেনোগ্রাফার হিসেবে। এরা তখন ওইসব দেশ থেকে পাঠায় দখলদার বাহিনীর গতি, ক্ষিপ্রতা, ফায়ার পাওয়ারের খবর। স্থানীয় জনগণের দুর্ভোগের কথা আড়াল করে দখলদার বাহিনীকে ‘মুক্তিদাতা’ হিসেবে সাজানো হয়।
পশ্চিমা মিডিয়ার এই জঘন্য দ্বিচারিতা অত্যন্ত নগ্নভাবে সামনে এসেছে ইউক্রেন ইস্যুকে ঘিরে। দখলদার রুশদের হাতে প্রাণ হারানো স্বর্ণকেশী, নীলনয়না ইউক্রেনীয় নাগরিককে ‘শহীদ’ হিসেবে তুলে ধরছে যে পশ্চিমা মিডিয়া, তারাই কিনা দখলদার ইসরায়েলিদের হাতে প্রাণ হারানো বাদামী চুলের ফিলিস্তিনি নাগরিককে কোনো ‘খবর’ বলেই মনে করছে না।
ইউরোপের বাইরের মানুষের জীবন মানেই যেন সস্তা, বাতিলযোগ্য। শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়দের জীবন যুদ্ধকবলিত হলে সেটা খবর, কিন্তু অন্যরা যুদ্ধের কবলে পড়লে সেটাই স্বাভাবিক।
চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে প্রাণ হারানো অগনন আরব, আফ্রিকান ও এশীয় মানুষের জীবনকে ওইসব দেশে ‘গণতন্ত্র’ আনতে পশ্চিমা দেশগুলোর ‘মহৎ’ উদ্যোগের গ্রহণযোগ্য ব্যয় হিসেবে দেখানো হয়েছে। আবার, দখলকৃত ফিলিস্তিন নিয়ে একের পর এক খবরে এমন বয়ান দাঁড় করানো হয়েছে যেন ‘ফুটবল মাঠে ছুটে বেড়ানো অথবা ঘুড়ি ওড়ানো কিশোর-কিশোরীদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহারকারী’ ‘সন্ত্রাসীরা’ ‘ইসরায়েলের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি’ সৃষ্টি করেছে এবং এই হুমকি নিরসনে পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট দেশটি যখন যাকে যেভাবে যে অজুহাতে ইচ্ছা মারতে পারবে।
এমন পক্ষপাতদুষ্ট ভাষ্য তৈরির অবধারিত ধারাবাহিকতা হলো, সব ভিকটিম মিডিয়া ও পাঠক-দর্শকের চোখে সমান থাকে না। বরং জাতীয়তা ও ধর্মের ভিত্তিতে কিছু ভিকটিম চিত্রায়িত হয় গোঁড়া অপরিণামদর্শী হিসেবে, যারা কিনা নিজেরাই নিজেদের জন্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাস্তুচ্যুত, কারারুদ্ধ, পঙ্গু ও নিহত হবার পরিণতি ডেকে এনেছে।
পশ্চিমা মিডিয়ার কর্ণধাররা এসব অভিযোগ পাশ কাটিয়ে গেলেও লন্ডন, নিউইয়র্কের নিউজরুম থেকে দূরে ভাবুক দর্শক ও পাঠক বিষয়গুলো স্পষ্ট বুঝতে পারবে। এজন্যই সম্প্রতি ইউক্রেন নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়ার ভাষ্যে অনেকেই তেমন অবাক হননি। যেমন, ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফে ‘ইনসাইট’ শিরোনামে বর্ণবাদী প্রতিবেদক লিখেছেন-‘‘ইউক্রেনীয়রা দেখতে আমাদেরই মতো এবং এটাই খুব উদ্বেগের বিষয়। কারণ যুদ্ধ শুধু দারিদ্র্যপীড়িত দূরের মানুষগুলোকে আক্রান্ত করছে না, আমাদের মতো যে কেউ যুদ্ধকবলিত হতে পারি।’’ এর অর্থ হলো- যেখানে ‘আমাদের মতো’ শ্বেতাঙ্গ মধ্যবিত্ত ইউরোপীয়রা আক্রান্ত হয়, সে যুদ্ধ অবশ্যই থামাতে হবে। কিন্তু যখন গরিব, দূরের দেশের, টেলিগ্রাফ রিপোর্টারের মতো দেখতে নয়, এমন মানুষরা আক্রান্ত হয় তখন এতো ভাবাভাবির কিছু নেই।
এনবিসির এক রিপোর্টার আরও সরেস। তার ভাবখানা এমন যেন ‘ইউরোপীয়রা সিরীয়দের মতো নয়’ এবং ‘যুদ্ধের সময় এটাই বিবেচ্য’। পোল্যান্ড থেকে এক সরাসরি সম্প্রচারিত প্রতিবেদনে ওই রিপোর্টার বলেন- ‘‘সোজাসাপ্টা বললে এইসব মানুষ সিরীয় শরণার্থীদের মতো নয়। এরা পাশের দেশ ইউক্রেন থেকে আসা শরণার্থী। এর মানে হলো, খোলাখুলিভাবে বলছি, এরা খ্রিস্টান, শ্বেতবর্ণের মানুষ। এরা পোল্যান্ডের মানুষের মতোই।’’
তবে শ্বেতাঙ্গ, ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্ববাদী মনোভাবের সবচেয়ে স্পষ্ট প্রকাশ ঘটিয়েছেন সিবিএস প্রতিনিধি। দর্শকের কাছে তিনি যেন ‘যুদ্ধের ক্ষেত্রে মুসলিম আর খ্রিস্টানের পার্থক্য’ তুলে ধরতে চেয়েছেন। ইউক্রেন থেকে লাইভ টিভিতে তিনি বলেন- ‘‘শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, এটা ইরাক অথবা আফগানিস্তানের মতো জায়গা নয় যেখানে দশকের পর দশক ধরে সংঘাত চলছে। এটা তুলনামূলক সভ্য, তুলনামূলক ইউরোপীয় শহর। আমাকে খুব সতর্কভাবেই শব্দচয়ন করতে হচ্ছে। এটা তুলনামূলক সভ্য ও তুলনামূলক ইউরোপীয় শহর যেখানে আপনি এমন যুদ্ধ আশা করবেন না।’’ মনে রাখা জরুরি যে এই সাংবাদিক সতর্কভাবে শব্দ বেছে নিয়েছেন এবং মার্কিন দর্শকদের বলেছেন যে ইউক্রেনীয়রা সভ্য, যার অর্থ হলো ইরাক ও আফগানিস্তানের মানুষ অসভ্য। আজিব ব্যাপার।
গত তিন দশকে কুয়েত, ইরাক ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র ও সমমনা দেশগুলোর সামরিক অভিযানে চিয়ার লিডারের ভূমিকা নেওয়া পশ্চিমা সাংবাদিক ও সংবাদ পাঠকরা ‘রেজিম চেঞ্জ’ বা সরকার বদলের মহিমা কীর্তন করেছে। অথচ এখন ইউক্রেনে ‘রেজিম চেঞ্জ’ করতে পুতিনের যুদ্ধ তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য হয়ে গেছে। বাগদাদ, ফালুজা, কাবুলে যা হয়েছে তা ছিল পশ্চিমা মিডিয়ার চোখে ‘শক অ্যান্ড অ’ (স্তব্ধ করে দেওয়া আঘাত); অন্যদিকে কিয়েভ আর খারকিভে যা হচ্ছে সেটা ‘বার্বারিক’ (বর্বরতা)। ভিন দেশে পশ্চিমা আগ্রাসনের নাম হয় ‘অপারেশন ফ্রিডম’ আর অন্যদের আগ্রাসন হলো ‘ওয়ার ক্রাইম’।
যেখানে হোক, যেভাবেই হোক, মানুষের দুর্ভোগ হোক সামষ্টিক উদ্বেগের, প্রতিবাদের বিষয়।
লেখক: Andrew Mitrovica, Al Jazeera columnist
অনুবাদ: সাইদ হাসান
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.