ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ে সোনালি ট্রফি উঁচিয়ে ধরেছে দুবার করে। ফুটবল মহাযজ্ঞে ল্যাটিন আমেরিকানদের এই তিন প্রতিনিধি। জায়ান্ট দল তিনটি নয়বার বিশ্বকাপ এনেছে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশে। বাকি ১২ বার স্বপ্নের শিরোপার আশ্রয় হয়েছে ইউরোপ মহাদেশে। এখানে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দল পাঁচটি।

euro vs copaতুলনামূলক পরিসংখ্যান: কোপা নয়, ইউরোই সেরা

জার্মানি ও ইতালি চারবার করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ফ্রান্স দুবার নিয়েছে সোনালি ট্রফি। স্পেন ও ইংল্যান্ড একটি করে শিরোপা জিতেছে। তাতেই স্পষ্ট ফুটবলের লড়াইটা কেবল দুই মহাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। গণ্ডি ছাড়াতে পারেনি অন্য মহাদেশের কোনো দলই। অন্তত প্রতি এক যুগে একবার করে হলেও দুই মহাদেশ প্রদক্ষিণ করছিল বিশ্বকাপ ট্রফি। কিন্তু প্রায় দুই দশক হয়ে গেছে ইউরোপ থেকে আর দক্ষিণ আমেরিকায় ট্রফি ফেরেনি।

এর নেপথ্যে বেশকিছু কারণ আছে। মূল কারণ দুই দেশের মহাদেশের ফুটবল প্রতিযোগিতা। ইউরোপে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ এবং ল্যাটিন আমেরিকায় কোপা আমেরিকা টুর্নামেন্ট। সম্প্রতি দুটি টুর্নামেন্টটি একটি আসর শেষ করেছে। যেখানে প্রায়সবকিছুতেই কোপার চেয়ে যোজন যোজন ব্যবধানে এগিয়ে ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতাটি। কেন কোপার চেয়ে ইউরো এগিয়ে এর স্বপক্ষে বেশকিছু যুক্তি তুলে ধরা হলো:

১. চ্যাম্পিয়নশিপে বৈচিত্রতা: কোপার চেয়ে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে বৈচিত্রতা লক্ষ্যণীয়। কোপায় উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল বরাবরই ফেভারিট থাকে। তিন দল মিলে শিরোপা নিয়েছে ৩৯ বার। চার দল যৌথভাবে ট্রফি জিতেছে আটবার। বেশ কয়েকটি দল তো এখনো ট্রফিই জিততে পারেনি। সেখানে ইউরোতে ১৬টি আসরে ১০টি দল ট্রফি জিতেছে। সবচেয়ে বেশি তিনবার করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে স্পেন ও জার্মানি। টুর্নামেন্টে প্রায়ই নতুন চ্যাম্পিয়ন দেখা যায়। গ্রিস, রাশিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, পর্তুগাল, ডেনমার্ক, চেক প্রজাতন্ত্রের রূপকথার আসরগুলো ইউরোর বড় একটা সৌন্দর্য্য। সবশেষ আসরেও নতুন দল হিসেবে ইংল্যান্ডের ট্রফি জয়ের সুযোগ ছিল।

২. বাছাইপর্ব: ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের মূলপর্বের টিকিট পাওয়াটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। মহাদেশজুড়ে ৫৫টি দেশ অংশ নিয়ে থাকে বাছাইয়ে। এই বাছাইপর্ব এতোটাই কঠিন যে, কখনো কখনো জায়ান্ট দলগুলোও বাদ পড়ে যায়। সেখানে কোপা আমেরিকায় নেই বাছাইপর্বের চ্যালেঞ্জ। ল্যাটিন দেশগুলো সরাসরি অংশ নেয় কোপা আমেরিকায়। এদিক থেকে কোপার চেয়ে পরিষ্কার ব্যবধানে এগিয়ে ইউরো।

৩. দল সংখ্যা: যে কোনো টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা বিবেচ্য বিষয়। ইউরোপজুড়ে ২৪টি দল অংশ নেয় ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে। স্বাভাবিকভাবেই বেশি দল মানেই জমজমাট লড়াই। সেখানে কোপা আমেরিকায় অংশ নেয় ১০টি দল। এবার অবশ্য আরো দুটি দল আমন্ত্রিত ছিল। যদিও করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে কোপায় অংশ নেয়নি জাপান ও কাতার।

৪. টুর্নামেন্টের আকার: ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে থাকে ২৪ দল। এই প্রতিযোগিতায় ম্যাচ বেশি। ফরমেশনও তাই মানসম্মন্ন। টুর্নামেন্টের আকারও তাই বড়। অন্যদিকে কোপা আমেরিকায় ইউরোর অর্ধেক দলও অংশ নেয় না। এই টুর্নামেন্টের আকারও তাই ছোট। এ ছাড়া ফরমেশনও মানসম্মত নয়। চার ম্যাচে দুই পয়েন্ট নিয়েও কোপার কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার নজির আছে। এবারের ইউরোতে ম্যাচ হয়েছে ৫১টি। সেখানে কোপায় স্থান নির্ধারণীসহ ২৮টি ম্যাচ হয়েছে।

৫. মাঠের মান: ‘নাচতে না জানলে উঠান বাকা’-এমন একটি প্রবাদ আছে বাংলা ভাষায়। ফুটবলে অবশ্য এই ব্যাপারে অজুহাত দেয়ার সুযোগ নেই। তবে নেইমার, ভার্গাস, ভিদালদের মতো তারাকারা কোপার ঘাসবিহীন উঁচু-নিচু মাঠ নিয়ে অভিযোগ করেছেন। কিন্তু ইউরোতে মাঠ নিয়ে অভিযোগ নেই কারোরই। কারণ এবারের ইউরো যে ১১টি মাঠে হয়েছে সেগুলো ছিল ছবির মতো মসৃণ ও মানসম্মত।

৬. প্রাইজমানি: কোপার তুলনায় ইউরোর প্রাইজমানি বেশি। সবশেষ আসরে চ্যাম্পিয়ন ইতালি প্রাইজমানি পেয়েছে ৩৪ মিলিয়ন ইউরো। এ ছাড়া অংশ নেয়া প্রতিটি দল পেয়েছে অন্তত ১০.৭৫ মিলিয়ন ইউরো। অন্যদিকে এবারের কোপার চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা প্রাইজমানি পেয়েছে ইউরোর অংশ নেওয়া দলগুলোর চেয়েও কম! বাংলাদেশি মুদ্রায় ইউরোতে অংশ নেওয়া ২৪ দলের প্রত্যেকে পেযেছে অন্তত ১০৮ কোটি টাকা। সেখানে কোপার চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা পেয়েছে প্রায় ৮৫ কোটি টাকা! অথচ এবারের ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালি পেয়েছে প্রায় ৩৪২ কোটি টাকা।

৭. গোল্ডেন বুট ও গোল সংখ্যা: ফুটবলের যে কোনো টুর্নামেন্টের অন্যতম আকর্ষণ গোল্ডেন বুট। লিওনেল মেসি ও লুইস দিয়াজ সাতটি করে ম্যাচ খেলে চারটি করে গোল করেছেন। যদিও বেশি অ্যাসিস্টের কারণে মেসি পেয়েছেন গোল্ডেন বুট। সেখানে তাদের চেয়ে কম ম্যাচ খেলে বেশি গোল করেছেন ইউরোর ফুটবলাররা। প্যাটট্রিক শিক ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো দুজনই সমান পাঁচটি করে গোল করেছেন। এর মধ্যে রোনালদো খেলেছেন চার ম্যাচ এবং শিক পাঁচ ম্যাচ। দলীয় হিসেবেও কোপার চেয়ে ম্যাচ প্রতি বেশি গোল হয়েছে ইউরোতে। ইউরোতে ম্যাচ প্রতি গোল হয়েছে ২.৭৮টি। সেখানে কোপা ম্যাচ প্রতি দেখেছে ২.৩২টি।

৮. সম্প্রচার: সম্প্রচার একটি সফল টুর্নামেন্টের অন্যতম দিক। এবারের কোপা আমেরিকার সম্প্রচারের মান ছিল অনেকটা নিম্নমানের। ঘোলাটে এবং ঝাপসা ছবি দেখা গেছে টেলিভিশনে। সেদিক থেকে ইউরোর ম্যাচগুলো বেশ এগিয়ে। ঝকঝকে ছবি এবং প্রাণবন্ত দেখা গেছে খেলাগুলো।

৯. স্থান নির্ধারণ: ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে ২৪ দল অংশ নিলেও নেই কোনো স্থান নির্ধারণী ম্যাচ। সেখানে কোপার ১০ দলের আসরে রাখা হয়েছে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচ। যা অনেকের কাছে যুক্তিহীন ও হাস্যকর। এই ম্যাচ নিয়ে আগ্রহ থাকে না তেমন কারোরই। আসলে এই ম্যাচটাও খেলতে চায় না কোনো দল।

১০. লড়াইয়ের ধরন: কোপা আমেরিকায় ম্যাচগুলো অনেকটাই একপেশে হয়ে থাকে। টুর্নামেন্টের সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন দলও নির্ধারণ করা যায়। কিন্তু ব্যতিক্রম ইউরো। এখানে শিরোপার দাবিদার থাকে বেশ কয়েকটা দল। ইউরোর অধিকাংশ ম্যাচই ছড়িয়েছে উত্তেজনার রেণু। ইউরোর সঙ্গে তুলনার করার মতো কোপায় একটি মাত্র ম্যাচ দেখা গেছে। ছয় গোলের ম্যাচে ৩-৩ গোলে ড্র করে পেরু ও প্যারাগুয়ে। এমন থ্রিলার একটা ম্যাচও খুব একটা প্রাণ ছিল না। এবারের কোপায় বড় কোনো অঘটনও ঘটেনি। সেখানে এবারের ইউরোতে বেশ কয়েকটা অঘটনই দেখা গেল।

১১. দর্শক উপস্থিতি: বরাবরই ইউরোর ম্যাচগুলো থাকে দর্শকঠাসা। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় কোপার ম্যাচে ফাঁকা আসন। এবার করোনাভাইরাসের কারণে অবশ্য দর্শক উপস্থিতিতে বেশ কড়াকড়ি ছিল। ভরা গ্যালারিতে কেবল সেমিফাইনাল ও ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওদিকে কোপায় একটি ম্যাচেই গ্যালারিতে দর্শক ছিল। সেটাও ফাইনালে। তাও আবার মাত্র ২৫ শতাংশ দর্শক দেখা গেছে গ্যালারিতে।

১২. ঘরোয়া লিগ: ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ অধিক জমজমাট ঘরোয়া শীর্ষস্থানীয় লিগগুলোর কারণে। স্পেন, ইতালি, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানির পেশাদার লিগ বিশ্বসেরা। এখানে খেলে থাকেন বিশ্বসেরা ফুটবলাররা। তাতে করে ফুটবলের কৌশল ও খেলোয়াড়দের স্কিল পর্যবেক্ষণ করা যায়। এর প্রভাব লক্ষ্যণীয় ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে। ইউরোপের শীর্ষ ক্লাব টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়নস লিগ বিশ্বের সেরা ক্লাব টুর্নামেন্ট। ল্যাটিন দেশগুলোর মধ্যে ব্রাজিলিয়ান লিগই যা জমজমাট। মহাদেশীয় ক্লাব প্রতিযোগিতা কোপা লিবার্তাদোরেস আগের মতো এখন আর রোমাঞ্চ জাগায় না।

১৩. রেফারিং: রেফারিং যে কোনো খেলার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের একটি সিদ্ধান্ত গড়ে দিতে পারে ম্যাচের ভাগ্য। এক্ষেত্রে বিতর্ক কম-বেশি দেখা যায়। তবে কোপার চেয়ে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচে রেফারিং বিতর্ক কমই দেখা যায়। এবারের কোপায় তিনটি ম্যাচে রেফারিং বিতর্ক দেখা গেছে। অন্যদিকে ইউরোতে একটি ম্যাচেই কেবল রেফারিং নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

১৪. ধারাভাষ্য: মানসম্পন্ন ধারাভাষ্যতে কোপার চেয়ে ইউরো অধিক গ্রহণযোগ্য। এবারের কোপায় ধারাভাষ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে কয়েকবার। তবে ইউরোর ধারাভাষ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। ভাষ্যকারদের প্রাণবন্ত আলোচনা ম্যাচের অন্যতম আকর্ষণ। যা টিভি দর্শকদের অনেকটাই রোমাঞ্চ উপহার দিয়ে থাকে।

১৫ বর্ণবাদ: ইউরোপের যে কোনো টুর্নামেন্টের বড় একটা সমস্যা হচ্ছে বর্ণবাদ। এর শিকার মূলত আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ফুটবলাররা। এবারের ইউরোর আসরজুড়ে এনিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এদিক থেকে কোপার দর্শকরা বেশ শৃঙ্খল। কোপায় সচারাচর বর্ণবাদের ঘটনা দেখা যায় না। এই একটা দিক বাইরে রাখলে তুলনামূলক বিচারে ইউরোর চেয়ে কোপা সর্বত্রই পিছিয়ে।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.