ইতালির পুনর্জন্ম

টানা তিনটি ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায়। টিকিট মেলেনি ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপেও। ইতালিয়ান ফুটবলে নেমে আসে সূর্যাস্ত। প্রায় ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে অবিশ্বাস্য এক প্রত্যাবর্তন করল ইতালি। রোববার রাতে ইউরোর ফাইনালে টাইব্রেকারে ইংল্যান্ডকে ৩-২ গোলে হারিয়ে আজ্জুরিরা জিতে নিল স্বপ্নের রুপালি ট্রফি।

তাতে পুনর্জন্ম হলো ইতালির। নতুন সূর্যোদয় হলো ইতালিয়ান ফুটবলের। অন্ধকার নেমে আসে ইংল্যান্ডজুড়ে। বনুচ্চি-কিয়েলিনিরা যখন শিরোপা উযাদপনে ব্যস্ত তখন হারের শোকে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে নেমে আসে শশ্মানের নীরাবতা। ইংলিশদের দুঃখ ৫৫ বছরের অপেক্ষার অবসান করতে না পারার। ঘরের মাঠে প্রথম ফাইনাল হেরে যাওয়ার।

ইংল্যান্ডকে হতাশায় ডুবিয়ে ৫৩ বছরের অপেক্ষার অবসান হলো ইতালির। তাতে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলল আজ্জুরিরা। আগের দুই আসরে স্পেন ও ফ্রান্সে কাছে ফাইনালে হারতে হয়েছে তাদের। তা না হলে অনেক আগেই ইউরোর দ্বিতীয় ট্রফির স্বাদ পেতে পারতো ইতালি। রবার্তো মানচিনির হাত ধরে এলো সাফল্য। অভিজ্ঞ ও তারুণ্যের দারুণ সমণ্বয় করেছেন এই কোচ।

অথচ শিরোপা রেখে দেওয়ার সম্ভাব্য সব প্রস্তুতিই সেরে রেখেছিল ইংল্যান্ড। ম্যাচ শুরুর আগে বর্ণিল আতশবাজির আলোকচ্ছটায় ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম হয়ে উঠেছিল অপরূপ। ম্যাচের দুই মিনিটের মধ্যে গোল করে উৎসবের অর্ধেক বন্দোবস্ত যেন করে ফেলেছিলেন লুক শ। ভরা গ্যালারি মেতে উঠল অগ্রিম শিরোপা জয়ের আনন্দে।

ভক্তদের আর দোষ কোথায়। হ্যারি কেনরা যেভাবে উদযাপনে মেতে উঠেছিলেন মনে হচ্ছিল শিরোপা-ই বুঝি জিতে গেছে থ্রি লায়নরা। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে পাল্টে গেল দৃশ্যপট। খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে ইতালি। ৬৭ মিনিটে লিওনার্দো বনুচ্চি গোল করে অতিথিদের ফেরান সমতায়। ম্যাচের বাকি সময় আর গোল দেখল না। অতিরিক্ত ত্রিশ মিনিটও কেটেছে গোলখরায়।

১-১ ড্রয়ের পর ফাইনাল গড়ায় টাইব্রেকারে। যেখানে সুবিধজনক অবস্থানে থেকেও শেষ পর্যন্ত হারের হতাশা সঙ্গী হয় ইংলিশদের। পেনাল্টি থেকে গোল করতে ব্যর্থ হলেন শেষ তিনজন তথা- মার্কাস রাশফোর্ড, জ্যাডন স্যানচো ও বুকায়ো সাকা। দ্বিতীয় ও পঞ্চম পেনাল্টি মিস করেও স্বপ্নপূরণ হলো আজ্জুরিদের। তাতেই হলো আরেক ইতিহাস।

ইউরো টুর্নামেন্টে প্রথমবারের মতো এক আসরে দুবার টাইব্রেকার জিতল কোনো দল। গ্যালারিতে তখন বিষাদের ছায়া। যা লন্ডন থেকে ছড়িয়ে পড়ল ম্যানচেস্টার, মার্সিসাইডের মতো রঙিন শহরগুলোতে। ইউরোর শিরোপা অধরাই থেকে গেল জায়ান্ট ইংল্যান্ডের কাছে। ১৯৬৬ সালে বিশ্বকাপ জেতার পর এটাই ছিল থ্রি লায়নদের দ্বিতীয় শিরোপা জয়ের উপলক্ষ্য।

পেনাল্টিতে রাশফোর্ড শট মেরেছেন গোলপোস্টে। পরের দুই শট ঠেকিয়ে দিলেন ইতালি গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি ডোন্নারুম্মা। পুরস্কার হিসেবে এই ইতালিয়ান পেয়েছেন টুর্নামেন্ট সেরার স্বীকৃতিস্বরুপ রুপালি বল। পাঁচ গোল করে গোল্ডেন বুট জিতেছেন পর্তুগালের ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। তার সমান গোল চেক প্রজাতন্ত্রের প্যাট্রিক শিকেরও। তবে কম ম্যাচ খেলায়, বাড়তি একটি অ্যাসিস্ট থাকায় রোনালদো পেয়েছেন গোল্ডেন বুট।

উদীয়মান সেরা হয়েছেন স্পেনের পেদ্রি। সেরা গোলরক্ষক হিসেবে গোল্ডেন গ্লাভস জিতেছেন জর্ডান পিকফোর্ড। ইতালির পক্ষে দ্বিতীয় শট নেওয়া আন্দ্রে বেলোত্তিকে নিরাশ করেন ইংলিশ গোলরক্ষক। আজ্জুরিদের শেষ পেনাল্টিটাও রুখে দিয়েছিলেন পিকফোর্ড। তবু শেষ রক্ষা হলো না। পঞ্চমবারও পেনাল্টি মিস ইংলিশদের। ইতি হলো সব নাটকীয়তার। শেষ হয়ে গেল ইংল্যান্ডের স্বপ্ন।

ম্যাচ শুরুর আগে স্বল্প পরিসরে হলো ইউরোর বিদায় অনুষ্ঠান। যেখানে জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখানো হয় আগের সব চ্যাম্পিয়ন দলের উল্লাস। এরপর ট্রফি নিয়ে আসেন গত আসরে পর্তুগালের ফাইনাল জয়ের নায়ক ও একমাত্র গোলদাতা এডার। কাল এডার হয়ে ওঠার সুযোগ ছিল লুক শ’র। ১ মিনিট ৫৭ সেকেন্ডেই করেন গোল। ইউরোর ফাইনালে এটাই সচেয়ে দ্রুততম গোল।

কিন্তু স্বপ্নের জার্সিতে স্বপ্নের মঞ্চে করা শ’র ক্যারিয়ারের প্রথম গোলটা আগলে রাখতে পারেনি ইংল্যান্ড। তবে অনেকটা সময় ইতালিকে ভুগিয়েছে তারা। বল নিয়ে ডি-বক্সের আশপাশ দিয়েই ঘুরপাক খেতে হয়েছে আজ্জুরিদের। একটা পর্যায়ে ফাইনাল হয়ে ওঠে ম্যাড়মেড়ে। ইতালি নিজেদের গুছিয়ে নিতে প্রথম ভাগের খেলা শেষ। দ্বিতীয়ার্ধেই দেখা গেল চেনা ইতালিকে। মুহুর্মুহু আক্রমণে ইংলিশদের নাস্তানাবুদ করে তোলে তারা।

এর সুফলটাও তারা পেয়েছে। তবে গোলটায় থাকল কিছুটা নাটকীয়তা। কর্নার থেকে উড়ে আসা বলে হেড করেন মার্কো ভেরাত্তি। পিকফোর্ডের গ্লাভস ছুঁয়ে বল ইংল্যান্ডের পোস্টে লেগে কোনাকুনি ভাবে ফিরে আসে। ওঁৎ পেতে থাকা বনুচ্চি আলতো টোকা দিতে ভুল করলেন না। ইতালি ফেরে সমতায়। আর বনুচ্চি হয়ে গেলেন ফাইনালের ‘বুড়ো’ গোলদাতা (৩৪ বছর ৭১ দিন)।

এরপরের প্রায় এক ঘণ্টা উত্তেজনার রেণু ছড়িয়েছে ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম। গোল না পেলেও টাইব্রেকারে বাজিমাত করে ইতালি। ১৯৬৮ সালের পর আবারো ইউরোপ সেরা তারা। কার্যত টানা ৩৪ ম্যাচ অজেয় থেকে বিশ্বরেকর্ডের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ইতালিয়ানরা। আর একটা ম্যাচ না হারলেই টানা ৩৫ ম্যাচ অজেয় থাকা ব্রাজিল ও স্পেনকে ছুঁয়ে ফেলবে আজ্জুরিরা।