আপনি পড়ছেন

মহান আল্লাহ বলেন, "হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের আগেরকার লোকদের দেয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার।" (বাকারা ২: ১৮৩)

laylatul qadr 2021

রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাব সহকারে রমজানের রোজা পালন করলো, তার পূর্বেকার সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাব সহকারে রমজানের রাতে নামায আদায় করলো, তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাব সহকারে লাইলাতুল কদরে নামায আদায় করলো তার ইতিপূর্বের জীবনের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (বুখারী)

রসুলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন,

"যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা ও সে অনুযায়ী কাজ-কর্ম এবং জাহেলী আচরণ ত্যাগ করতে পারলো না তার খানা-পিনা ছেড়ে দেয়াতে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।" (বুখারী)

আমার ইবাদতগুলি কবুল হচ্ছে তো:

এ এক চিরন্তন প্রশ্ন। সব মুমিনের আত্মার পেরেসানী। আমি যা কিছু করলাম ও করছি- নামায, রোজা, দান-সাদাকা ও নেক আমল তা আল্লাহ কবুল করছেন তো? প্রকৃত বিষয় আল্লাহই ভাল জানেন। তবে আল্লাহতা’লা এর কিছু নিশানী তাঁর কালামে একং রাসূল (সা.) তার হাদীসে বর্ণনা করেছেন। যাতে মুমিন বান্দা-বান্দীরা আত্মযাচাই ও মূল্যায়ন করতে পারে। তাদের আমলগুলি আরো কার্যকর ও জোরদার করার উদ্যোগ নিতে পারে।

১. রোজার মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন:

> আমার-আমাদের রোজা, তারাবী, যাকাত, সাদাকা এ সব ইবাদত কবুল হলো কিনা তার মূল্যায়নের জন্য রোজা সম্পর্কে মূল আলোচনায় ফিরে যাওয়া প্রয়োজন।

> আল্লাহ বলেন,

"রোজা রাখ যেন তাকওয়া পরহেজগারী God-consciousness তৈরি হয়। আল্লাহর হুকুমগুলি মেনে চলা এবং নিষেধ করা কাজগুলি বর্জন করার আত্মিক শক্তি ও অভ্যাস তৈরি হয়।

> রসুলুল্লাহ (সা.) তার হাদীসে বিষয়টি আরো ব্যাখ্যা করে বললেন, রোজা ঠিকমত আদায় করলে তুমি-

# মিথ্যা কথা বলা থেকে বাঁচতে পারবে।

# মিথ্যার উপর যেসব কাজ করা হয় (যেমন- সব রকম অন্যায়, দুর্নীতি ও বেহায়াপনা) তা থেকে ফিরে থাকতে পারবে।

# অজ্ঞতাপ্রসূত ও জাহেলী কর্মকাণ্ড, বিবেকহীন আচার-আচরণ থেকে বাঁচতে পারবে।

# এখন রোজার শেষ বেলায় এসে সব রোজাদারের নিজেকে জিজ্ঞাসা করা দরকার। এ ক্ষেত্রে সে যতটুকু এগুতে পেরেছে।

আল্লাহ যেসব বড় বড় গুনাহর কাজ করতে নিষেধ করেছেন সেগুলোর কোনটির সাথে কি সে জড়িত ছিল? থাকলে, রোজা থেকে সেগুলো থেকে সে কতটুকু বিরত হতে পেরেছে?

১.১ মিথ্যা কথা বলা: রসুল (সা.) বলেছেন, মিথ্যা কথা মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে। আজকের বিশ্বে কথায় কথায় মিথ্যা বলা সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কোনো বস্তুগত লাভের আশায় যেমন মানুষ মিথ্যা বলছে, তেমনি আসর গরম করার জন্য, নিজেকে খুব যোগ্য করে দেখানোর জন্য মিথ্যা বলছে। এমনকি লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নিজের বানোয়াট স্বপ্নের কথাও বলে মানুষেরা। পেশাজীবীরা মিথ্যা বলছেন, বলছেন রাজনীতিবিদরা- মিথ্যা ওয়াদা দিচ্ছেন মানুষদের। স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে, পিতা-মাতা সন্তান-সন্তাতিকে, সন্তানেরা মা-বাবাকে, মিথ্যার এক ভয়াবহ বিস্তার ঘটছে গোটা সমাজজীবনে। সিয়াম মিথ্যার বিরুদ্ধে ঢাল, মিথ্যা থেকে বাঁচার হাতিয়ার। রোজাদারেরা ভেবে দেখি মিথ্যা কথা ছাড়তে পারলাম কতটুকু? মিথ্যাবাদীদের সংস্থা-সংঘ ত্যাগ করলাম কতটুকু? মিথ্যাবাদীদের সাথে চলে কি সত্যবাদী থাকা যায়? মিথ্যুকের সাথে চলে কি আল-আমীনের (সা.) দলভুক্ত হওয়া সম্ভব?

১.২ মিথ্যার উপর আমল: মিথ্যা সব পাপের মা। সমস্ত পাপ কাজের মূল ভিত্তি একটা মিথ্যা। যা যথার্থ নয়, সে আয়ের যথার্থতার ভিত্তি নেই। সে সম্পর্ক যথার্থ ভিত্তির উপর স্থাপিত নয়- তা-ই মিথ্যা। যেমন- দুর্নীতি, ঘুষের টাকা ও সম্পদ। এটি তার প্রাপ্য নয়। একটা মিথ্যার উপর সে এটা হাসিল করছে। সুদের ক্ষেত্রেও একই কথা। সুদের কারবার, মাপে-ওজনে কম দেয়া ইত্যকার সবকিছুই মিথ্যার উপর প্রতষ্ঠিত। ব্যভিচার একটা অবৈধ বা মিথ্যা সম্পর্কের পরিণতি। শিক্ষকরা ক্লাস না পড়িয়ে যে কোচিং বাণিজ্য করে, চাকরিজীবী বা শ্রমিকেরা যে কাজ না করে মাস শেষে বেতন বা কাজ শেষে যে মজুরি নেয় তার ভিত্তিও তো মিথ্যাই। কেউ বলতে পারে তাহলে তো সবই মিথ্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সব মিথ্যা নয়, সত্য-সততার উপরই সমাজের বেশির ভাগ বিষয় এখনো। তবে হ্যাঁ, মিথ্যাচার এখন প্রবল, তার পরিবেশ অনুকূল। রোজা এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ।

রোজাদারকে রোজা দেয় এর বিরুদ্ধে আত্মিক, দৈহিক ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তি। দাবি জানায় এগুলো থেকে মুক্ত হওয়ার। পেঠ খালি সারাদিন, সারা মাস যে আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য সেই আল্লাই তো এসব কাজ সব সময়ের জন্য নিষিদ্ধ করেছেন। আল্লাহর হুকুম কোনো সরকারের হুকুমের চেয়েও গুরুত্তপূর্ণ, তাই তো রোজাদার কেউ না দেখলেও এগুলো থেকে সারা মাস পরহেজ করেছেন। দিন-রাত আল্লাহর হুকুম তামিলে কাটিয়েছেন। পরহেজ করে চলার, হুকুম মানার অভ্যাস তৈরি করেছেন। হ্যাঁ, যে তা চেয়েছে তাকে তার তাওফীক আল্লাহ দিয়েছেন। মুসলমান সমাজে অন্ধ,বধির, বিবেক বর্জিত ইবাদতের নামে আনুষ্ঠানিকতা পালনের যে রেওয়াজ চালু হয়েছে তাতে আত্মিক শক্তি, পরহেজগারীর গুণ অর্জন কতটুকু হয় তা চিন্তার বিষয়। হয় যে না, এই করোনাকালীন দুর্নীতি, নিয়ম-শৃঙ্খলার প্রতি চরম অবহেলা, জীবনের চেয়েও মার্কিটিংয়ের গুরুত্ব দেখে তা-ই বোঝা যায়। ঈদ মার্কেটে দেখা গেল দোকানীর কাপড়ের বস্তা খোলার আগেই মাহিলারা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কাপড়ের দখল নেয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় নেমে গেলেন। মা-বোনদের সম্মান রক্ষার জন্য শালীন ভাষায় বলতে হলো। বাকীটা নিজেরা বুঝে নেই। উনাদের অসম্মান তো আমার নিজেরই অসম্মান। তা না করাই সমীচীন।

রোজাদারের, অর্থাৎ আমরা সবাই ভেবে দেখি এই যে মিথ্যা-ভিত্তিক কাজ-কারবারের সয়লাব, তা থেকে কতটুকু নিজেদের বাঁচাতে পারছি।

১.৩ জাহেলী কর্মকাণ্ড: ইসলাম বহির্ভূত যাবতীয় সব আচরণই জাহেলী কর্মকাণ্ড। একটা দিক দেখি- ইসলাম সব কাজেরই একটা আদব বা প্রকৃতি ঠিক করে দিয়েছে। যেমন- বসে খাও, ডান হাতে খাও, বিসমিল্লাহ বলে খাও। পিতা-মাতাকে সর্বোচ্চ সম্মান করো, তাদের বৈধ ইচ্ছাগুলিকে সম্মান করো; ছোটদের স্নেহ করো, ভুল-ত্রুটি উপেক্ষা করো; গৃহকর্মী, কর্মচারী-মজুরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করো, তাদের হকগুলো আদায় করো; পশু-পাখি, গাছপালার হক আদায় করো ইত্যাদি প্রতিটি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আচরণ ও ব্যবহার পদ্ধতি ইসলাম শিক্ষা দিয়েছে। একে আমরা আদব বলি। দুঃখজনকভাবে আদবের শিক্ষা, শিক্ষা কারিকুলাম থেকে উঠে গেছে, উঠে গেছে পরিবার থেকে। এই যে সমাজে এত রকম অনাচার তার অন্যতম মূল কারণ এ শিক্ষার অনুপস্থিতি। সবার কাছে আবেদন, মেহেরবানী করে নিজেরা ইসলামের আদবগুলি পুনরুজ্জীবিত করি। সন্তানদের শিক্ষা দেই। শিক্ষা কারিকুলামে তা জোরদারভাবে অন্তর্ভুক্ত করি।

রোজাদার সব রকম জাহেলী কর্মকাণ্ড তথা ঝগড়া-বিবাদ, গীবত-চোগলখুরি, অসংযত আচরণ ইত্যাদি থেকে বেঁচে থাকবে, কেন? যেন এটাই তার আচরণবিধি হয়ে দাঁড়ায়। তার দ্বারা যেন এর অন্যথা না হয়। কতটুকু পারছি? আত্মযাচাই করি।

২. রোজা ও ইবাদতগুলি কবুল হওয়ার আরেক আলামত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লার প্রতি মনোভাবে পরিবর্তন ও উন্নতি। এ ক্ষেত্রে ৩টি বিষয় লক্ষণীয়।

২.১ আল্লাহর ইবাদতে অতৃপ্তি: প্রকৃত মুমিন বান্দা আল্লাহতা’লার যথাযথ মর্যাদা উপলব্ধি করে এবং সে বুঝে যে যতই ইবাদত করুক তা যথেষ্ট হয়নি। আল্লাহতা’য়ালার মহান মর্যাদার তুলনায় তা নিতান্তই সামান্য। তাঁর যথেষ্ট শোকর করা হয়নি। মানুষের জীবনে তাঁর রহম ও করমের সামান্য কৃতজ্ঞতাটুকুও আদায় হয়নি। এটাই বাস্তব। দীর্ঘ আলোচনার তো সুযোগ নেই। উদাহরণস্বরূপ এই যে করোনার সময় অক্সিজেন সংকট। কি অবলীলায় আয়েশে কোনো সচেতন ক্রিয়াকলাপ ছাড়াই তা গ্রহণ করছি, শ্বাস ত্যাগ করছি। সামান্য টান পড়ে গেল তো কি পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছি? এই অক্সিজেনটুকু গ্রহণে আমার মধ্যে এবং বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে কত ব্যবস্থা আল্লাহ করেছেন!! সুবহানাল্লাহ! তারপরও মূর্খ মানুষ আল্লাহকে অবজ্ঞা করে, তাঁকে সচেতনভাবে ভুলে থাকে। ভুলে থাকার জন্য, অন্যকে ভুলিয়ে রাখার জন্য নানা রকম চাকচিক্য আর আয়োজন! আহা আল্লাহর বান্দারা কথা বলে, টকশো করে, নিজের বন্দনা গায়, অন্যের দোষ বয়ান করে, অথচ তার স্রষ্টা তার মহান মালিক সৃষ্টিকর্তার নামটুকু নেয় না, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতার একটা শব্দও উচ্চারণ করে না। হায়রে মূর্খ, হায়রে বখিল!

এ বেচারারাই নাকি বুদ্ধি ব্যাপারী, এ হতভাগ্যরাই নাকি জাতির ভবিষ্যত গড়ার কারিগর! সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকেই আল্লাহর তসবীহতে রত আছেন একদল ফিরিস্তা। কিয়ামতের দিন যখন মিযান প্রতিষ্ঠিত হবে সেই দিন তারা মাথা তুলে কথা বলার অনুমতি পাবে। আর তারা কি বলবে? বলবে হে প্রভু! আপনার যথেষ্ট তসবীহ করা হয়নি।

হতভাগ্য মানুষ এক মাস কোনো রকম না খেয়ে থেকে, ইমামের পিছনে অমনোযোগিতা নিয়ে, অন্য খেয়ালে রাতের কিছু অংশ দাঁড়িয়ে থেকে ধারণা করছে যে, না জানি কি বিরাট কিছু করেছে। এ কথাই আল্লাহ তাঁর কালামে বলেন-

“তারা আল্লাহর যথাযথ সম্মান করে না। কিয়ামতের দিন সমস্ত পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুষ্টিতে এবং আকাশমণ্ডলী থাকবে ভাঁজ করা অবস্থায় তাঁর ডান হাতে। পবিত্র ও মহান তিনি, তারা যাকে শরীক করে তিনি তার উর্ধে।” (যুমার ৩৯: ৬৭)

মুমিন বান্দার মনেও ওই ফিরিস্তাদের মতো একই চিন্তা- আমি আমার রবের যথেষ্ট ইবাদত, তাঁর উপযুক্ত সম্মান, তাঁর প্রতি যথাযথ কৃতজ্ঞতা দেখাতে পারিনি। এ অনুভূতি তার মধ্যে তৈরি ইবাদতের ক্ষুধা। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে আরো পেরেসানী। সে তখন ইবাদত বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হয়- নামায, রোজা, সাদাকা, দ্বীনের পথে প্রচেষ্টা-কুরবানী, ইলম অর্জন, ইলম বিতরণ, দ্বীনের দাওয়াত প্রভৃতি কাজে আরো সচেষ্ট হয়:

“তোমরা দ্রুত অগ্রসর হও নিজ প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে এবং সেই জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি আসমান ও জমীনের মতো, যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে মুক্তাকীদের জন্য, যারা স্বচ্ছল ও অস্বচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করে এবং যারা ক্রোধ সংবরণকারী এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল: আল্লাহ তো মুহসিন বান্দাদের ভালবাসেন। আর যারা কানো অশ্লীল কাজ করে ফেললে অথবা (কোনো গুনাহ করে) নিজেদের প্রতি জুলুম করে ফেললে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া কে পাপ ক্ষমা করবে? আর তারা যা করে ফেলে, জেনে শুনে তার পুনরাবৃত্তি করে না।” (সুরা আলে-ইমরান : ১৩৪-১৩৫)

যে ব্যক্তি রোজা কতদিনে শেষ হবে সে অপেক্ষায় আছে, আর যে রোজা শেষ হয়ে যাবে এই নিয়ে পেরেসান তারা এক নয়। প্রথম ব্যক্তি এখনো ইবাদতের স্বাদ পায়নি। সে দ্বীনের অনুষ্ঠানগুলি পালন করছে মাত্র। মহান আল্লাহর প্রকৃত মর্যাদা সে উপলব্ধি করেনি এখনো। আল্লাহ তার দিল-অন্তঃকরণ খুলে দিন। আর দ্বিতীয় ব্যক্তি ইবাদতের বসন্ত রমজান শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে চিন্তিত। তার গুনাহ মাফ হলো কিনা পেরেসান। তার মালিক তার উপর খুশী কিনা এ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আল্লাহতা’লা নিশ্চয়ই তাঁর মুহসিন বান্দাদের ভালবাসেন। এদের মতো হওয়ার তাওফীক আল্লাহ আমাদের সকলকে দিন। কতটুকু সেদিকে অগ্রসর হতে পারলাম তা চিন্তা করে দেখি।

২.২ আল্লাহর হকের ব্যাপারে সচেতনতা: রোজা আমাদের আল্লাহমুখী জীবনযাপনে তালিম ও অভ্যস্ত করার জন্য। আমাদের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাঁরই দেয়া নেয়ামত। চোখ, কান, জিহ্বা, হাত-পা, চিন্তাশক্তি, অন্তঃকরণ- তথা দেহের প্রতিটি অঙ্গ তাঁরই দান। এসবের কতটুকু তাঁর জন্য ব্যয় করছি তা বিবেচ্য। দিনে কয়েক ওয়াক্ত নামায, বছরের এক মাস রোজা একবার ফিতরাতুল যাকাত দিলেই যারা মনে করেন তারা আল্লাহর জন্য যথেষ্ট করে ফেলেছেন, তাদের উচিত নিচের আয়াতটির দিকে লক্ষ করা-

“নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার যাবতীয় ইবাদত-বন্দেগী, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু শুধুমাত্র আল্লাহর (সন্তুষ্টির) জন্যই।” (আনআম ৬: ১৬২)

আমাদের সময়, সম্পদ ও প্রচেষ্টায় আল্লাহর শেয়ার কতটুকু বাড়লো তা আমরা পর্যালোচনা করে দেখি।

২.৩ আল্লাহর প্রতি সুধারণা: রসুলুল্লাহ (সা.) এক হাদীসে কুদসীতে বলেন:

“আল্লাহ বলেন, আমার প্রতি বান্দার ধারণা অনুযায়ী আমি তার সাথে আচরণ করি।” (বুখারী, মুসলিম)

তাই আল্লাহর প্রতি সুধারণা পোষণ করা মুমিনের মৌলিক পুঁজিগুলির একটি। আল্লাহ বলেন-

“হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের প্রতি (গুনাহর দ্বারা) জুলুম করেছো তারা আল্লাহর (অফুরন্ত) রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব পাপ ক্ষমা করে দিবেন। তিনি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (যুমার ৩৯: ৫৯)

এ এক আশাজাগানিয়া মহান সংবাদ। আল্লাহ বান্দাকে আশ্বস্ত করছেন যে, তিনি তার সব পাপ, ছোট-বড়, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব পাপ ক্ষমা করে দিবেন। তাহলে আমাকে অর্থাৎ বান্দাকে কি করতে হবে? রোজায় তার তালিম পেয়েছি আমরা।

> আল্লাহর দিকে অগ্রসর হতে হবে রাতে-দিনে, শয়নে-জাগরনে, কাজে-অবসরে।

> তাঁর বিধানের নিকট আত্মসমর্পণ করতে হবে।

> আল্লাহর কল্যাণময় বিধান যা কিছু কুরআন ও সুন্নাহয় বর্ণিত আছে তা সাধ্যমতো জানতে-মানতে সচেষ্ট হতে হবে।

> আল্লাহর প্রতি দায়িত্বে অবহেলা, শিথিলতা করা যাবে না।

> মুত্তাকীদের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। অর্থাৎ নিজে তাকওয়া-ভিত্তিক জীবনযাপন করতে হবে। তাকওয়া ওয়ালা লোকদের সাথী হতে হবে।

> দুনিয়ার জীবনে যতদিন হায়াত আছে তাঁর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করতে হবে। মৃত্যুর পর যেন আফসোস করতে না হয়। (সুরা যুমার ৩৯: ৫৪-৫৮) (সুরা যুমারের ৬ষ্ঠ রুকুখানি পাঠ করার জন্য সবার প্রতি অনরোধ থাকলো)

অতএব, নিজে সাধ্যমতো চেষ্টা করবো দ্বীনের পথে চলতে। সেই সাথে আল্লাহর প্রতি সুধারণা রাখবো। আশা রাখবো যে, তিনি-

> আমার ইবাদতগুলি কবুল করে নিচ্ছেন

> আমার গুনাহগুলি মাফ করে দিবেন।

> আমার দোয়াগুলি কবুল করছেন।

# রোজায় আমার চিন্তা-মানসিকতার মধ্যে উল্লিখিত বিষয়গুলি কতটুকু বাড়লো তা চিন্তা করে দেখি সবাই।

৩. রোজা একটা চেতনা, একটা Life-style, একটা চিন্তা-পদ্ধতি, একটা সামগ্রিকতার ধারণা।

৩.১ রোজা বান্দার মধ্যে উবদিয়াত বা দাসত্বের চেতনা সৃষ্টি করে:

একটা মাস, সারাটা দিন সার্বক্ষণিক আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত রাখে রোজা। দিনে খালি পেটে ক্ষুধার্ত অবস্থায় সচেতন থাকতে হয়- রোজা ভেঙে যায়, দুর্বল হয়ে যায়- এমন কোনো কাজ না করে ফেলি। রাতে ক্লান্ত শরীরে বাড়তি ইবাদত ও শেষ রাতে জাগরণ- সারাদিনই রোজা বান্দাকে আল্লাহর ইবাদতে নিবিষ্ট থাকার প্রোগ্রাম দেয়। সারা বছর রোজা থাকতে ইসলাম আমাদের বলে না। কিন্তু আল্লাহর বন্দেগীর এই চেতনা যেন সারাটি বছর, প্রতিটি ক্ষণে প্রতিটি কাজে থাকে তাই ইসলামের দাবী। রোজা সেই প্রশিক্ষণই দেয়। আমি কতটুকু তা অর্জন করতে পারলাম?

৩.২ দায়িত্বশীল জীবন-যাপন:

রোজায় রসুল (সা.) বেশি বেশি সাদকা করতেন। আমরাও করি। সওয়াব যেন অনেক বেশি হয়, রমজানে যাকাত দেই অধিকাংশ বেশি সওয়াবের আশায়। ফিতরার সাদাকা দিয়ে রোজা শেষ করে ঈদের নামায পড়তে যাই। এসবই এক দায়িত্বশীল জীবন-যাপনের চেতনা ও অভ্যাস সৃষ্টির জন্য। আমাকে নিয়েই এ জগত নয়। আজ চারিদিকে কেবল আমি, আমি, আমি। সাধারণ মানুষ থেকে শাসকবর্গ সর্বত্র আমিত্বের জয়জয়কার। কেবল নিজেকে নিয়েই চিন্তা। রোজা তাতে প্রবল এক ধাক্কা দেয়ার জন্য আসে প্রতি বছর। না, তুমি এখানে একা নও। একা বাঁচতে পারো না এক মুহূর্তও। সবাইকে নিয়ে বাঁচতে হবে। সবাইকে নিয়ে আগাতে হবে। সম্পদ ব্যাংকের লকার থেকে বের কর। ছড়িয়ে দাও সবার মাঝে, সৃষ্টি কর কর্মউদ্দীপনা, কর্মমুখী জীবন, ঈদের মতো আনন্দমুখর হোক প্রতিটি দিন। আমি কি আমিত্বের আল্লাহ বিরোধী বেড়াজাল থেকে বের হতে পেরেছি? সবার কথা চিন্তা করছি?

৩.৩ উম্মাহ কেন্দ্রীক চেতনা:

এই রোজার মাস, সারা বিশ্বের মুসলিম এক সাথে রোজাদার। রোজা শেষে ফিতরা দিচ্ছে। ঈদের নামায পড়ছে। তোমাদের এই উম্মাহ এক উম্মাহ।”

ইসলামের এই মৌলিক চেতনা রোজার অন্যতম শিক্ষা। উম্মাহ ভাল থাকলে আমিও ভাল থাকবো, উম্মাহর বিপদ তো আমারও বিপদ। হাদীসের শিক্ষা হল- মুসলমানরা সব ভাই ভাই। এক দেহের মতো। এক স্থানে আঘাত লাগলে বাকী দেহেও তার ব্যথার কষ্ট অনুভব হবে। হচ্ছে কি আমাদের? সিরিয়ার সেই শিশুটির কথা কি মনে আছে- আমি আল্লাহকে গিয়ে সব বলে দিব। কিংবা সেই ইয়েমেনী মেয়েটি যে বলেছিল, তাড়াতাড়ি মরে যাই তা-ই ভাল। আল্লাহর কাছ গিয়ে তো খেতে পারবো। আমাদের মাংস-রুটির দলাগুলি তখন গলায় একটু হলেও আটকেছিল কি? ও তো আমার-আপনারও সন্তান হতে পারতো। আমি-আপনিও তো হতে পারতাম। আসলে তো ওরা আমাদেরই সন্তান। ওরা তো আমি আর আপনিই। এটাই তো ইসলামের শিক্ষা। রোজা আসে আমাকে-আপনাকে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও ক্ষুধার কষ্টের অনুভূতি দিতে। যাতে যারা নিরবচ্ছিন্ন ক্ষুধায় কষ্ট পাচ্ছে তাদের কথা চিন্তায় আর অনুভূতিতে আনতে পারি। এসেছে কি আমাদের মধ্যে সেই চিন্তা, সামান্য হলেও। নাকি পত্রিকার ঈদ রেসেপি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এই সমাজ আর তার মিডিয়াগুলো আমাদের ভোগী হতে বলছে। তারা মাঝে মাঝে দু’টাকা খরচ করে কোটি কোটি টাকার প্রচারনা চালানোর শিক্ষা দিচ্ছে। আর আল্লাহ আমাদের সব সময় সার্বক্ষণিক দায়িত্বশীল ও ত্যাগী জীবন শিক্ষা দিচ্ছেন, ইবাদতগুলি তারই প্রশিক্ষণ। রোজা তাঁরই তালিম। আমি এই উম্মাহর এক সদস্য হিসেবে উম্মাহর প্রতি আমার দায়িত্বের ব্যাপারে কতটুকু সচেতন হতে পেরেছি এই রোজার শেষে তা মূল্যায়ন করি।

শেষ কথা হলো- রোজা কবুল হচ্ছে কিনা, লাইলাতুল কদর পেলাম কিনা উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলি আমাদের তার খবর দেয়। আমাদের অনেকেই অনেক সুন্দরভাবে রোজা করেছি। আসলেও এই বিষয়গুলি তাদের চিন্তায় ছিল, তারা এগুলো আরা উন্নত করেছেন; শানিত করেছেন। আমরা সবাই তাদের মতো হই। আল্লাহ তাওফীক দিন। আবার কেউ কেউ আছি কিছু কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে। আবার অনেক বিষয়ে এখনো অনেক দুর্বলতা। আশা না হারাই। আল্লাহর প্রতি সুধারণা রাখি। তাওফীক চাই। প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখি। আবার অনেকে আছি, হয়তো অনেক বেশি দুর্বল। কোনো রকম রোজা ছিলাম। অনেক ত্রুটি হয়ে গেছে। চিন্তার কারণ নেই- এমন কথা বলবো না। বরং চিন্তা করি বেশি বেশি। তবে হতাশ না হই। এই যে চিন্তা করছি এটাই উন্নতির প্রথম ধাপ। কোথায় সমস্যা ভেবে দেখি। কুরআন-হাদীস অধ্যয়ন করি, দ্বীনদার সংঘ-সোহবতে চলার চেষ্টা বাড়াই। আর সর্বোপরি আল্লাহর কাছে দোয়া করি আন্তরিকভাবে যেন আল্লাহ আমাদের তাঁর নেক বান্দাদের সামিল করে নেন। গুনাহ-খাতা পাক-সাফ করে আরো পবিত্র সুন্দর-দায়িত্বশীল ইসলামী জীবনযাপন করার তাওফীক দান করেন। এটাই হোক এই রোজার চেতনা, রোজার সিদ্ধান্ত। আল্লাহ সবাইকে তাওফীক দিন, কবুল করুন।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.