আপনি পড়ছেন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে করোনাভাইরাস একটি ছোঁয়াচে রোগ। এজন্য করোনা রোগীর কাছে ঘেঁষা নিষেধ। তবে রোগটি যতটা না ভয়ংকর তার চেয়ে বেশি ভয়ংকর আমাদের নেতিবাচক প্রচার ও আচরণ। ফলে সমাজ একজন করোনা রোগীর সঙ্গে অমানবিক আচরণ করছে। করোনা রোগী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে স্ত্রী, সন্তান, এমনকি বাবা-মাও। করোনায় কেউ মারা গেলে তার দাফনও জানাজার জন্য লোকজনও পাওয়া যাচ্ছে না।

coron1

শহরগুলোতে করোনায় আক্রান্ত হলে বাড়ির মালিক বাসা থেকে বের করে দিচ্ছে। ইতিমধ্যে আমরা সংবাদ মাধ্যমে জানতে পেরেছি, করোনা সন্দেহে সন্তান মাকে জঙ্গলে ফেলে চলে গেছে। প্রিয়তমা স্ত্রীকে হাসপাতালে ভুয়া ঠিকানায় ভর্তি করিয়ে লাশ রেখেই পালিয়ে গেছে স্বামী।

যদি কারো সর্দি-কাশি ও জ্বর হয় তাহলেই আমরা করোনা রোগী সন্দেহ করে নির্মম আচরণ করতে থাকি তার প্রতি। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সর্দি কাশি কিংবা জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের না আসার নির্দেশ দিয়ে ব্যানার ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। ভাবখানা এমন যেন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি মহা অপরাধ করে ফেলেছেন। আর পুরো সমাজ সে অপরাধকে ঘৃণার চোখে দেখাকে কর্তব্য মনে করে নিয়েছে।

আশ্চর্য! একজন পুঁজিপতি সুদখোর, দুর্নীতিবাজ, চোর, বাটপারের প্রতিও আমরা এতটা ঘৃণা দেখাই না, যতটা ঘৃণা করছি একজন অসহায় করোনা রোগীকে। কেউ কেউ করোনায় মৃতের লাশ দাফন না করে আগুনে পুড়িয়ে ফেলার কথা বলছেন।

যদিও চিকিৎসকরা জোর দিয়েই বলেছেন, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে ৩ ঘণ্টার বেশি সময় জীবাণু থাকে না। মারা যাওয়ার পর আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের জীবাণুও মরে যায়। তবুও করোনা রোগীকে দাফন করতে কেনো অনীহা প্রকাশ করছে একদল মানুষ তা আমাদের বুঝে আসে না।

করোনা ভাইরাসকে ইতিমধ্যেই দুর্যোগ ও মহামারি বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ইসলাম মহামারিতে মারা যাওয়া মুমিনকে শহিদ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। এসব শহিদদের দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা অবশ্যই উচিত। মানবিক কারণে আলেম সমাজ করোনা রোগীর দাফন কাফনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করছেন।

গত ২৭ মে বুধবার বাঁশখালীর শেখেরখীলে শওকত আলম চৌধুরী নামে একজন করোনাক্রান্ত শহিদ ভাইয়ের লাশ দাফন করি আমরা। এই লাশ দাফন করতে গিয়ে বেশ তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হতে হয়েছে আমাদেরও। লাশ দাফন করে আমরাও যেন অপরাধী হয়ে গেলাম। অনেকেই লাশ দাফনকারী টিমকে বাঁকা চোখে দেখার পাশাপাশি অপমানের চোখেও দেখছিলো সেদিন। যা সত্যিই বেদনাদায়ক।

টিমের একজন সদস্য জানান, নেতিবাচক প্রচারণার ফলে লাশ দাফন করতে যাচ্ছেন শুনে তার পরিবারের লোকজন তাকে ঘরে আসতে বাধা দিচ্ছিলো। পরে বাধা উপেক্ষা করে তিনি লাশ দাফন করতে চলে আসেন। অন্যদিকে আমি লাশ দাফনের কাজে অংশ নিয়েছি শুনে আমার সহকর্মী-বন্ধুবান্ধবরা আমার পাশে ঘেঁষেনি। অনেকে আমার বিরুদ্ধে বলে বেড়াচ্ছিলো, আমি নাকি করোনা ছড়িয়ে দিচ্ছি। এও বলা হয়েছে, লাশ দাফনের কাজে অংশ নেয়ার কারণে ৭২ ঘণ্টা কেউ যেন আমাকে না ছোঁয়।

অথচ পারসোনাল প্রটেকশন, হ্যান্ড গ্লাভস, মাস্কসহ যাবতীয় সুরক্ষা নিয়েই আমরা লাশ দাফন করেছিলাম। লাশ এবং আমাদের শরীরে একটু পরপরই স্প্রে করা হয়েছে। দাফন কাফনের পর টিমের সবাই স্পটেই গোসল জীবাণুমুক্ত হয়েছি। সব ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করার পরও কেনো আমাদের সঙ্গে এমন নির্মম আচরণ করেছে মানুষজন তা আমাদের বুঝে আসেনি।

corona 2

আমাদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে লাশের স্বজন এবং প্রতিবেশীরা। যার লাশ দাফন করলাম তিনি ছিলেন জমিদার পরিবারের ছেলে। গ্রামে রাজকীয় বসতভিটা তাদের। বিশাল পুকুরসহ বড় এরিয়া নিয়ে তার বাড়ি। শেষে ওই বাড়িতে আমাদের ঢুকতেও দেওয়া হয়নি। আমাদের পৌঁছতে একটু দেরি হয়েছিলো। গিয়ে দেখি লাশ অ্যাম্বুলেন্সে করে বাড়ি থেকে অনেক দূরে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছে। আমরা শেখেরখীল পৌঁছে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লাশ গাড়ি থেকে নামিয়ে গোসল করিয়ে কাফন পরাই।

গোরস্থানে নিয়ে যাওয়ার আগে আমরা মৃতের স্ত্রী-পরিবারের সদস্যদের শেষবারের মত লাশকে দেখে নিতে বলেছিলাম। হায়! তারা না লাশ দেখলা, না লাশকে একবারের জন্য বাড়িতে ঢুকতে দিলো। হে প্রভু! কেয়ামতের দিন স্বজন-স্বজনকে চিনবে না, প্রিয়জন-প্রিয়জনকে ফেলে দূরে চলে যাবে- যে কথা তুমি কোরআনে বলেছো সে নির্মম দৃশ্য এ দুনিয়াতেই দেখা হয়ে গেলো!

কী আর করা। আমরাই কাঁধে চড়িয়ে লাশ দাফনের জন্য গোরস্থানেরউদ্দেশে রওনা করি। অবশ্য তখন আমাদের পেছন পেছন লাশের কয়েকজন স্বজন ও প্রতিবেশী বেশ খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে আসছিলো। আমরাই অনুরোধ করেছিলাম তাদেরকে আসার জন্য। জানাজার নামাজেও মৃতের প্রিয়জনদের উপস্থিতি খুব একটা ছিলো না। জানাজার নামাজ যদিও ফরজে কেফায়া, কিন্তু জানাজার চেয়ে মানুষটিকে শেষবারের মতো দেখা, তার পাশে থাকা এসব তো মানবিক ব্যাপার, ভালোবাসার দাবি।

দাফন এবং জানাজা শেষে আমাদের ফেরার পালা। আসার সময় টিমের একজন সদস্য তার হ্যান্ড গ্লাভসটি খুলে সড়কের পাশের ডোবায় ফেলে দেয়। এতেই ঘটে বিপত্তি। প্রতিবেশী কয়েকজন দৌড়ে এসে গ্লাভসটি দূরে কোথাও ফেলে দিতে বললেন।

তারা বললেন, এ গ্লাভস থেকে নাকি পুরো এলাকায় করোনা ছড়িয়ে যাবে। হায়! কেমন আমাদের চিন্তা-চেতনা। বার বার স্প্রে করার পরও মাত্র একবার ব্যবহার করা একটি হ্যান্ড গ্লাভসকেও সহ্য করলো না এলাকাবাসী। অথচ তারাই আবার কোনো ধরনের সামাজিক দূরত্ব কিংবা স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চায়ের দোকানে, এখানে-সেখানে অযথা আড্ডা দিয়ে বেড়ায়।

ভাবুন তো! একদিন যদি আপনি-আমি করোনায় আক্রান্ত হই, তাহলে আপনাকে আমাকে নিয়ে যদি পরিবার, সমাজ এমন অমানবিক আচরণ করতে থাকে, তখন কেমন লাগবে নিজের কাছে। হে আল্লাহ! আমাদের মরা বিবেক জাগিয়ে দিন।

লেখক : সম্পাদক জীবন্ত কাগজ পত্রিকা, পরিচালক দারুল কারীম মাদরাসা, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.