শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনালে ইংল্যান্ডের বাজিমাত

শেষ ওভারে এমন নাটক বিশ্বকাপে আগে দেখা যায়নি। ক্রিকেট ইতিহাসের কোনো ম্যাচেও এমনটি বিরল। প্রতিটি বলেই ছিল স্নায়ুর চাপ। মহা নাটকীয় ফাইনাল শেষ পর্যন্ত নিষ্পত্তি হলো সুপার ওভারে। যেখানে দুই দলই সমান ১৫ রান করেছেন। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী বেশি বাউন্ডারির কারণে বাজিমাত করেছে ইংল্যান্ড।

নিউজিল্যান্ড হারল পরপর দুটি ফাইনাল। অস্ট্রেলিয়ার পর এবার ইংলিশদের কাছে। অন্যদিকে চতুর্থ ফাইনালে এসে শিরোপা জিতল ইংল্যান্ড। এর আগে ১৯৯৬ সালে নতুন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে শ্রীলঙ্কাকে পেয়েছিল ক্রিকেট দুনিয়া।

শুরুটা খারাপ হলেও বাটলার আর স্টোকসের ব্যাটে ম্যাচটা ঝুঁকে গিয়েছিল ইংল্যান্ডের দিকে। এরপর জস বাটলারের আউটেই জমে ওঠে ফাইনাল। শেষ তিন ওভারে ৩৪ রানের সমীকরণ ইংল্যান্ডের সামনে। ১২ বলে ২৪ এবং ৬ বলে ১৫। শেষ ওভারে লড়াইটা হলো ট্রেন্ট বোল্ট বনাম বেন স্টোকস। প্রথম দুই বলে বোল্টের দুর্দান্ত দুটি ইয়র্কারে পরাস্ত হয়েছেন ইংলিশ অলরাউন্ডার।

তখন চার বলে ১৫ রানের আরো কঠিন সমীকরণ। তৃতীয় বলেই ছক্কা হাঁকান স্টোকস। পরের বলে দুই রানের জন্য ছুটেছেন স্টোকস ও আদিল রশিদ। তখনই আরেক নাটক। গাপটিলের থ্রো স্টোকসের ব্যাটে লেগে হয়ে যায় চার। দুই বলে ১২ রান করে ফেলা ইংল্যান্ডের জয় তখন হাতের মুঠোয়। দুই বলে দরকার তিন রান।

পঞ্চম বলে দুই রান নিতে গিয়ে রান আউট হয়ে যান কোনো বল না খেলা রশিদ। শেষ বলেও একই দৃশ্য। এবার রান আউট হলেন মার্ক উড। দুই বলে হলো দুই রান। থ্রিলার ম্যাচ টাই! ফাইনাল গড়ায় সুপার ওভারে। যেখানে বোল্টের ওভারে দুই চারে ১৫ রান করেছে ইংল্যান্ড। তিন বলে সাত রান করেছেন বাটলার। সমান বলে আট রান এসেছে স্টোকসের ব্যাট থেকে।

ট্রফি জিততে জাদুকরি ওভারে নিউজিল্যান্ডের দরকার ১৬ রান। ইংল্যান্ডের স্বপ্ন বাঁচানোর দায়িত্ব জোফরা আর্চারের হাতে। আর্চার প্রথম বলে ওয়াইড দেন, পরের বলে দুই রান। দ্বিতীয় বলে তাকে ছক্কা মেরে নিউজিল্যান্ডকে জয়ের স্বপ্ন দেখাতে থাকেন জিমি নিশাম। জয় তখন কাছেই। চার বলে সাত রান দরকার কিউইদের।

পরের দুই বলে দুই রান করার পর পঞ্চম বলে এক রান নেন নিশাম। শেষ বলে গাপটিলের সামনে দুই রানের সমীকরণ। কিন্তু এক রান নেওয়ার পর রান নেওয়ার পর দ্বিতীয় রানের জন্য ছুটতে গিয়ে রান আউট হয়ে গেলেন গত বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। তাতেই কেঁপে উঠল লর্ডস স্টেডিয়াম। স্টাম্প ভেঙেই বাটলার এবং ইংলিশরা মেতে উঠেন উচ্ছ্বাসে।

চ্যাম্পিয়ন হলো স্বাগতিক ইংল্যান্ড। সুপার ওভার ও ম্যাচে বেশি বাউন্ডারির কারণে জয়ী ঘোষণা করা হয় ইংলিশদের। পুরো ম্যাচে নিউজিল্যান্ড যেখানে ১৬টি বাউন্ডারি মেরেছে, সেখানে ইংল্যান্ড মেরেছে ২৪টি। ফাইনাল নির্ধারণ হলো তাতেই।

এর আগে ২৪২ রানের লক্ষ্যমাত্রায় ব্যাট করতে নেমে ৮৬ রানের মধ্যে চার উইকেট হারিয়ে ফেলে ইংল্যান্ড। এ সময়ে সাজঘরে ফিরে গেছেন জেসন রয় (১৭), জনি বেয়ারস্টো (৩৬), জো রুট (৭) ও ইয়ন মরগান (৯)। শুরুর এই বিপর্যয় পঞ্চম উইকেট জুটিতে সামলে নিয়েছে ইংলিশরা।

জস বাটলার ও বেন স্টোকসের ব্যাটে চড়ে জয়ের স্বপ্নই দেখছিল স্বাগতিক শিবির। এই জুটিতে ১১০ রান করে ফেলে। ম্যাচটা অনায়েসে ইংলিশরা জিতবে এমনটাই ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু ফাইনাল না জমলে কী চলে! বাটলারকে আউট করে ম্যাচ জমিয়ে দেন লোকি ফার্গুসন। ইংলিশ তারকাকে টিম সাউদির দুর্দান্ত ক্যাচে পরিণত করেন।

বাটলার ফিরেছেন ৬০ বলে ৫৯ রান করে। তবে এক প্রান্ত আগলে রেখে শেষ পর্যন্ত টিকে ছিলেন স্টোকস। ৯৮ বলে ৮৪ রানে অজেয় ছিলেন তিনি। তার দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ের সুবাদে ম্যাচটা সুপার ওভারে নিয়ে যেতে পেরেছে ইংল্যান্ড। সুপার ওভারেও আলো ছড়ানো স্টোকস শেষ অবধি ফাইনাল সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন।

এর আগে টস জিতে আগে ব্যাট করতে নেমে ৩১ রানে ওপেনার মার্টিন গাপটিল উইকেট হারায় নিউজিল্যান্ড। টুর্নামেন্টজুড়ে নিজেকে হারিয়ে খোঁজা গাপটিল এদিন দারুণ শুরুর পর ১৮ বলে ১৯ রানে আউট হয়ে গেছেন। শুরুর ধাক্কা কিউইরা সামলে উঠেছে দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে।

হেনরি নিকোলাস ও কেন উইলিয়ামসন যোগ করেন ৭৪ রান। এই জুটি ভাঙতেই ছন্দ হারায় নিউজিল্যান্ড। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে তারা। ব্যক্তিগত ৩০ রানে সাজঘরে ফিরে গেছেন উইলিয়ামসন। টুর্নামেন্ট জুড়ে ব্যাটিংয়ের ঘানি টানা অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান এদিন আউট হয়ে গেলেন ১৫ রানে।

১৪১ রানে দলের চতুর্থ ব্যাটসম্যান হিসেবে সাজঘরে ফিরেছেন টেলর। ১৭৩ রানে নিউজিল্যান্ডের পঞ্চম উইকেটের পতন। জেমস নিশাম সাজঘরে ফিরে যান ১৯ রান করে। কলিন ডি গ্র্যান্ডহোম ১৬ রানে ফিরেছেন। দলীয় সর্বোচ্চ ৫৫ রান করে নিকোলাস নিউজিল্যান্ডের ইনিংসের ভালোই মেরামত করেছেন।

লড়াকু পুঁজি গড়তে টম লাথামের ৪৭ রানের ইনিংসটিও বেশ কার্যকর ছিল। নিউজিল্যান্ডের পতন হওয়া আট উইকেটের তিনটি করে নিয়েছেন লিয়াম প্লাঙ্কেট ও মার্ক উড। কিন্তু আলো ছড়ানোর পরও সুপার ওভারে তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি অধিনায়ক মরগান। তরুণ আর্চার ১৫ রান দিয়েও দলকে জিতিয়েছেন।

আসলে নিউজিল্যান্ডের ভাগ্যে ট্রফি লিখে রাখেননি ক্রিকেট বিধাতা। আর তা না হলে গাপটিলের থ্রো কেন স্টোকসের ব্যাটে লেগে চার হয়ে যাবে। কেনই বা ট্রেন্ট বোল্ট ৪৯তম ওভারের চতুর্থ বলে স্টোকসের ক্যাচ নিয়ে পেছনে গিয়ে বাউন্ডারিতে পা ছোঁবেন। নিশামের বলে বেঁচে যাওয়া স্টোকস পেলেন ছক্কা! গুরুত্বপূর্ণ ওভারে বাড়তি দশ রান দিয়ে স্বপ্নভঙ্গ নিউজিল্যান্ডের।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

নিউজিল্যান্ড: ২৪১/৮
ইংল্যান্ড: ২৪১/১০
ফল: ম্যাচ টাই

সুপার ওভার: দুই দলই করেছে ১৫ রান। কিন্তু বেশি বাউন্ডারির কারণে ম্যাচ চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড। পুরো ম্যাচে নিউজিল্যান্ড যেখানে ১৬টি বাউন্ডারি মেরেছে, সেখানে ইংল্যান্ড মেরেছে ২৪টি।