মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নারী গৃহকর্মীদের দূর্বিসহ জীবন

সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পাড়ি জমানো নারীদের মুখে প্রায়ই শোনা যায় নির্যাতন ও নিগৃহীতের কথা। এসব নারীদের দুঃখ, বঞ্চনা নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া। সেই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বিদেশে পাড়ি জমানো এসব নারীদের লোমহর্ষক অভিজ্ঞতার কথা।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মূলত নারীদের গৃহকর্মী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তবে তাদের প্রায় বেশিরভাগেরই রয়েছে বিভৎস অভিজ্ঞতা। শারীরিক লাঞ্ছনার পাশাপাশি বেশিরভাগ নারীকেই শিকার হতে হয় যৌন নির্যাতনের। ঠিক মতো বিশ্রাম তো দূরের কথা, ন্যায্য বেতনের টাকাটাও পাওয়া যায় না ঠিকমতো। বেতনের টাকা চাইতে গেলে করা হয় নানা রকমের নির্যাতন। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরে আসা এসব নারী গৃহকর্মীদের এমনই সব দুর্দশার কথা উঠে এসেছে টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে।

জয়নব বেগম, যার বাড়ি ভারতের হায়দরাবাদের। গৃহকর্মের সহযোগী হিসেবে জয়নবকে পাঠানো হয় সৌদি আরবে। সেখানে পৌঁছার পরই তিনি বুঝতে পারেন জীবন কতটা কঠিন হতে পারে। প্রায় এক বছর হতে চললো তিনি সেখান থেকে দেশে ফিরেছেন। সৌদি থাকাকালীন কষ্টের দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে বিমর্ষ হয়ে পড়েন তিনি।

নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জয়নব বলেন, আমাকে বাড়িতে ফোন করতে দেয়া হতো না। ফোন করার চেষ্টা করা হলে করা হতো নির্যাতন। বেতন চাইতে গেলে হাতের কাছে যেটি পড়ে থাকতো তা দিয়ে আমাকে আঘাত করা হতো। নানান ধরনের হুমকিও দেয়া হতো। অনেক সময় এমন হয়েছেে আমি অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে নিজের জীবন নিজেই বের করে দেয়ার চেষ্টা করেছি।

একটা সময় জয়নবের পরিবার বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারে। তাকে মুক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনতে ভারত সরকারের কাছে আবেদন করেন তার পরিবার। পরে রিয়াদে নিয়ুক্ত ভারতীয় দূতাবাস তাকে এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে উদ্ধার করে। দেশে ফিরিয়ে আনা হলেও সেই দুর্বিসহ জীবনের আতঙ্ক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি জয়নব।

সৌদি আরবে নিয়োগকারীদের হাতে নির্যাতন ও অপমানের শিকার আরেক নারী শাহিনগরের ইলিয়াস বেগম। তিনি বলছেন, আরও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা। তিনি কোনোমতে বেঁচে যান তার নিয়োগকারীর ছেলের যৌন নির্যাতনের হাত থেকে। নিয়োগকারীর ছেলের অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ইলিয়াস বেগমকে দিতে হয়েছে চরম মূল্য।

ইলিয়াস বেগম বলেন, দুবাইতে ভালো বেতনের কথা বলে ২০১৬ সালে আমাকে একটি চাকরির প্রস্তাব দেয়া হয়। সবকিছু বিবেচনা করে আমি রাজি হয়ে যাই। কিন্তু দুবাই পৌঁছানোর পর তারা আমাকে আমাকে রিয়াদে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে অতিরিক্ত কাজের প্রতিবাদ করলে তারা লোহার রড দিয়ে আমাকে পেটাতো।

অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, একবার নিয়োগকারীর ছেলের কুপ্রস্তাবে রাজি না হয়ে আমি দৌড়ে তৃতীয় তলায় চলে যাই। তখন আমাকে তিন তলা থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়া হয়। আমাকে তিন মাস হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিলো। হাসপাতালে নিযুক্ত ভারতীয় কর্মীরা আমাকে ব্যাপক সাহায্য করেছিলেন।

পরে ইলিয়াস বেগম স্বামী মোহাম্মদ খানের আবেদনের প্রেক্ষিতে ভারতীয় দূতাবাস তাকে উদ্ধার করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়। তবে এখনও চিকিৎসার জন্য ইলিয়াস বেগমকে নিয়মিতভাবে হাসপাতালে যেতে হয়।

আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে তিনি বলেন, দেশে ফিরতে পেরেছি। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে। আশা করি, একদিন হাঁটতে পারবো। স্বামীর ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকবো না।

সাইদাবাদের সিঙ্গারেনি কলোনির অধিবাসী আমিনাও ইলিয়াস বেগমের মতো আরেক নারী। প্রথমে তাকে দুবাই নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেখান থেকে পাচার করে দেয়া হয় সৌদি আরবে।

দুঃখ করে আমিনা বলেন, দিনে একবার আমাকে খাবার দেয়া হত। পানির জন্য তাদের কাছে ভিক্ষা চাইতাম। তারা আমাকে প্রচুর নির্যাতন করতো। নির্যাতন সহ্য করেও আমাকে সারাদিন কাজ করতে হতো। একদিন সুযোগ বুঝে মালিকের বাসা থেকে পালিয়ে পুলিশ স্টেশনে যাই। পরে পুলিশের সহায়তা এবং ভারতীয় দূতাবাসের চেষ্টায় ভারতে ফিরতে সক্ষম হই।

নির্যাতনের স্বীকার এসব নারীরা বলেন, এখনও অনেক নারী মধ্যপ্রাচ্যে অকল্পনীয় নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে। তাদের ওপর চালানো হচ্ছে অমানবিক অত্যাচার।