আপনি পড়ছেন

উনিশ শত সত্তর সালের কথা, সৌদি আরবের তখন তেলের রমরমা ব্যবসা। সে সময় পেপসি কোম্পানির কর্মকর্তারা ভারতের মোহাম্মাদ ইকবালের বাড়ি-ঘর পরিদর্শনের পর তাকে সৌদি আরবে তাদের (পেপসি) সরবরাহ ট্রাকের চালক হিসেবে কাজের প্রস্তাব দেয়। আর সেই প্রস্তাবেই সাড়া দিয়ে ইকবাল এক দল বিদেশি শ্রমিকের সঙ্গে সৌদি আরবে পাড়ি জমান।

saudi workers 1সৌদি আরবে একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করছেন ফিলিপাইনের নাগরিক খ্রিস্টিয়ান লাক্যাপ। ছবি: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট

সৌদি সরকারের উচ্চাকাঙ্ক্ষী উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে শ্রমিকরা, প্রায়ই স্বল্প মেয়াদের চুক্তিতে, দেশটিতে যায়। তিন সন্তানের জনক ইকবাল কয়েক দশক ধরে দেশটিতে অবস্থান করছেন এবং একের পর এক কাজ সংগ্রহ করেছেন, ‍যদিও সৌদি সরকারের অগ্রাধিকারের (চাওয়া) পরিবর্তন হয়েছে এবং রিয়াদ বিদেশি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে নিয়মকানুন আগের চেয়ে কঠোর করেছে।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি সরকার নীতিগত যেসব পরিবর্তন এনেছেন তাতে ৬০ বছরের ইকবালকে বিকল্প চিন্তা করতে বাধ্য হতে হচ্ছে।

সৌদি সরকার দেশটির বিদেশি শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল নাগরিকদের ওপর অতিরিক্ত ফি নির্ধারণ করেছে এবং নির্দিষ্ট কিছু সেক্টরে বিদেশি শ্রমিকদের কাজের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেছে।
অন্যদিকে, একমাত্র তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে রিয়াদ যেসব সংস্কার প্রক্রিয়া হাতে নিয়েছে, তার প্রভাব পড়েছে অল্প আয়ের বিদেশি শ্রমিকদের ওপর, অনেক ক্ষেত্রেই তাদের জন্য কষ্টকর হয়েছে। আর এর ফলে দেশটির শ্রমশক্তির একটা বড় অংশ সৌদি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে।

তবে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মাদ বিন সালমান দেশটির অর্থনীতিকে পুনঃনির্মাণের যে দুরুহ চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন, তার ওপর প্রভাব ফেলেছে বিদেশি শ্রমিকদের এই আকস্মিক প্রস্থান। যুবরাজের সংস্কার প্রক্রিয়ার অন্যতম লক্ষ্য হলো বেসরকারি খাতে সৌদি নাগরিকদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যেটা এখন প্রায় পুরোটাই বিদেশি শ্রমিকদের কব্জায়।

কিন্তু বিদেশি শ্রমিকদের চলে যাওয়ার কারণে যেসব ক্ষেত্র ফাঁকা হচ্ছে সৌদি নাগরিকরা তাৎক্ষণিকভাবে সেটা পূরণ না করায় সমস্যায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরা, যার প্রভাব ইতোমধ্যে সৌদি অর্থনীতি লক্ষ করা যাচ্ছে।

সৌদি সরকারের পরিসংখ্যান সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, ২০১৭ সালের শুরু থেকে গেল বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের মধ্যে ১১ লাখের বেশি বিদেশি শ্রমিক সৌদি আরব থেকে চলে গেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি শ্রমিকদের যে বড় বহর সৌদি ছেড়েছে তা এই প্রথম নয়। ২০১৩ ও ২০১৭ সালেও হাজার হাজার বিদেশি শ্রমিক দেশটি ছেড়েছে অথবা ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। তবে সৌদি সরকারের ঘোষিত বিশেষ ওয়ার্ক ভিসা সুবিধা লঙ্ঘনের কারণে রিয়াদ সরকারের সাঁড়াশি অভিযানের ফলে যখন ব্যাপক হারে বিদেশিরা প্রস্থান করছে তখন বিদেশি ও দেশটির নাগরিকদের ওপর এর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে।

সেইসঙ্গে সৌদি নেতারা যখন দেশটির দুর্দশাগ্রস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট এবং সম্প্রতি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে ওয়াশিংটন পোস্টের কলাম লেখক সাংবাদিক জামাল খাসোগি খুন হওয়ায় ক্ষুণ্ন ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছেন তখন শ্রমিকদের এই গণপ্রস্থান দেশটিতে একটি অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে।

আর এই পরিস্থিতি যে সৌদি সরকারকেও বিস্মিত করেছে তাও লক্ষ্য করা গেছে। মার্কিন গণমাধ্যম ব্লুমবার্গ বলছে, পরিস্থিতি ঠেকাতে গত বছরের শেষ দিকে সৌদি কর্মকর্তারা বিদেশি শ্রমিকদের ওপর আরোপিত অতিরিক্ত ফি প্রত্যাহার বা সহজ করার কথা বিবেচনা করেন, কারণ ওই নীতির কারণে দেশটির অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তবে বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি, বরং আগের মতোই ফি কার্যকর আছে।

সৌদি সরকারের এই নীতির, বিদেশি শ্রমিক বিতাড়ন, কারণে দীর্ঘ মেয়াদে দেশটির তরুণদের অর্ধেকের বেশি কর্মসংস্থান খুঁজে পাবে। আর সেটা বাস্তবে করা গেলে দেশটির তরুণদের মধ্যে হতাশা দূর হবে এবং সৌদি নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়া থেকে রেহাই পাবেন, যেটা আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশে হয়েছে।

কিন্তু বিগত দুই বছরে দেশটিতে সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৯ শতাংশের যে উচ্চ বেকারত্বের চিত্র লক্ষ্য করা গেছে তা একটি ব্যাপক উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রমবর্ধমান এই বেকারত্ব স্বল মেয়াদে কর্মসংস্থান সৃষ্টি সংক্রান্ত নীতি পুনর্বিবেচনার জন্য সরকারকে বাধ্য করছে। সেইসঙ্গে সৌদি শ্রমিকদের প্রত্যাশা এবং দেশটিতে বিদ্যমান কর্মসংস্থানের সুযোগের, বিদেশি শ্রমিক চলে যাওয়ার কারণে, মধ্যে একটি বড় ধরনের দূরত্ব তৈরি করছে, বিশেষত নির্মাণ শ্রমিক কিংবা খুচরা বিক্রেতার মতো নিম্নমানের কাজ (যেটা তারা করতে আগ্রহী নন)।

পারস্য উপ-সাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের গবেষক কারেন ইয়াং বলেন, সৌদি নারীরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছেন এটা ভালো সংবাদ। কিন্তু উচ্চ শিক্ষিত এমন অনেকে আছেন যারা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাচ্ছেন না।

ইয়াং বলেন, সৌদি যুবরাজ গত বছর তথাকথিত দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে দেশটির কয়েক শ ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা এবং রাজপরিবারের সদস্যকে গ্রেফতার করার যে আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করেন তার কারণে দেশটির ব্যবসায়িক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শঙ্কার মধ্যে পড়ে যান।

তবে সরকার যে এই অথনৈতিক উদ্বেগের প্রতি সাড়া দিচ্ছে না তা নয়। গত সপ্তাহে চার মাসের মাথায় সৌদি সরকার দ্বিতীয় বৃহৎ বিনিয়োগ সম্মেলনের আয়োজন করেছে, যার লক্ষ্য হলো- দেশটির খনি, জ্বালানি ও অন্যান্য শিল্পে লাখ লাখ ডলার বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা। এ ছাড়া গত সপ্তাহে সৌদি কর্তৃপক্ষ ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে শুরু করা সেই দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করেছে।

এ ছাড়া বিনোদন ও পর্যটন খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ এবং এসব খাত সবার (নারী-পুরুষ) জন্য উন্মুক্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। যদিও এই উদ্যোগ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। এমনকি সমালোচকদের কোণঠাসা করার নানা উদ্যোগ নিয়েছেন যুবরাজ।

এদিকে, শ্রমিকদের গণহারে প্রস্থানের চিত্র ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। ভবনগুলো খালি পড়ে আছে, যেসব স্টোর বিদেশিদের দ্বারা পরিচালিত তারা কেউ টিকে থাকার চেষ্টা করছে আবার অনেকেই শাটার বন্ধ করে দিয়েছেন। কম-বেশি মোটামোটি সবাই জানে, অনেক পরিবারই ইতোমধ্যে চলে গেছে অথবা যারা আছে তাদেরও বাড়ির পথ ধরতে হবে।

পরিবার ছাড়া যারা রয়েছে তারাসহ যারা এই চিন্তা করছে এবং কয়েক বছর সৌদি আরবে অবস্থান করছে তারা তাদের সঞ্চয় বাড়ানোর চেষ্টা করছে অথবা উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠাচ্ছে। আর যারা খুব উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে তারা সৌদি আরবের বাইরে কাজ খুঁজছে।

ফিলিপাইনের নাগরিক খ্রিস্টিয়ান লাক্যাপ, ‍যিনি বিগত সাত বছর ধরে সৌদি আরবের উপকূলীয় শহর জেদ্দায় কাজ করেন, বলছেন, তিনি সৌদি ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ হিসেবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির, অর্থনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসেবে সরকারের আরোপিত নীতির ফলে, কথা উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, ‘সৌদি নাগরিকরা অনেক বেশি বেতনে চাকরি করে, ফলে তারা বর্ধিত মূল্য বহন করতে পারে। কিন্তু আমাদের সর্বনিম্ন বেতন, তাই অতিরিক্ত খরচ বহন করা আমাদের জন্য খুবই কঠিন।’

রেস্টুরেন্টে কাজ করা লাক্যাপের জন্য ফিলিপাইনে কাজের কোনো ব্যবস্থা নেই, তাই তিনি অন্য কোনো দেশে যাওয়ার চিন্তা করছেন। সেটা হতে পারে দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা কানাডা- যেখানে তার কর্মের অপেক্ষাকৃত বেশি সুযোগ আছে।

তিনি বলেন, তিনি সন্দেহ করছেন, কোনো সৌদি শ্রমিক তার কাজটি নিয়ে নেয় কি না।

অন্যরাও, যেমন- ইকবাল, বলছেন, তারা এই মুহূর্তের জন্য পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে চলছেন।

ইকবাল সর্বশেষ একটি মার্কেট রিসার্চ কোম্পানি থেকে চাকরি হারিয়েছেন, যেটি সরকারের বর্ধিত ফিয়ের কারণে কোম্পানির আকার ছোট করতে বাধ্য হয়েছে। এরপর থেকে ইকবাল কোনো কর্ম খুঁজে পাননি।

তিনি আশঙ্কা করছেন, ‘সৌদিকরণে’র কারণে বিদেশি শ্রমিকদের স্থলে যেখানে স্থানীয়রা জায়গা করে নিচ্ছে সেখানে তার বয়সের কারণে কর্ম খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।

তিনি বলছেন, ইউলিটি ও দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বেড়েছে। তার স্ত্রীর, যার ডায়াবেটিক রোগ, জন্য ওষুধ কেনা ব্যাপক ব্যয়বহুল হয়েছে। তার অনেক বন্ধুবান্ধব ইতোমধ্যে চলে গেছে। সুতরাং, তিনি মনে করেন, তার চলে যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার।

ইকবাল বলেন, ‘কেউ এখানে থাকতে চায় না। প্রত্যেকেই ভারতে ফিরে যাচ্ছে। আমার আরো পাঁচ থেকে ছয় বছর সৌদি আরবে থাকার ইচ্ছা ছিল। আমার খুব খারাপ লাগছে, কিন্তু আমি কিইবা করতে পারি?’

সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.