খাসোগি হত্যাকাণ্ড: যেভাবে সৌদিকে বাধ্য করলেন এরদোয়ান

সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে চতুর কুটনীতিকের পরিচয় দিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়্যিপ এরদোয়ান। বিশ্লেষকরা বলছেন, অতি কৌশলে বিষয়টি সামাল দিচ্ছেন এই তুর্কী নেতা।

গত ২ অক্টোবর ব্যক্তিগত কাগজপত্র সংগ্রহে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের সৌদি দূতাবাসে গিয়ে নিখোঁজ হন সৌদি রাজপরিবারের সমালোচক সাংবাদিক জামাল খাসোগি। শুরু থেকেই তুরস্ক দাবি করেছে দূতাবাসেই খাসোগিকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু সৌদি আরব প্রথম দিকে বিষয়টি অস্বীকার করলেও অনেকটাই বাধ্য হয়ে গত শনিবার দূতাবাসেই হত্যাকাণ্ড হয়েছে বলে স্বীকার করে।

এক্ষেত্রে তুর্কী প্রেসিডেন্টের ভূমিকার প্রশাংসা করে আল জাজিরার তুরস্ক প্রতিনিধি জিনিয়া খোদর বলেন, ‘খাসোগি নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই এরদোয়ানের ভূমিকা ছিল জাত কূটনীতিকের মত। তিনি খুব ভেবে চিন্তে কথা বলেছেন, এ ক্ষেত্রে বরাবরই কাউকে নির্দিষ্ট করে অভিযোগ না করে তিনি পাশ কাটিয়ে কথা বলেছেন। সৌদি আরবকে দিয়ে তিনি দোষ স্বীকার করিয়ে ছেড়েছেন।’

এরদোয়ানের কৌশলে পথ চলা

হত্যার পর দিন ৩ অক্টোবর: খাসোগির তুর্কী বাগদত্তা হটিস সেনগিজ অভিযোগ করেন, ২ অক্টোবর খাসোগি ইস্তাম্বুলের সৌদি দূতাবাসে ঢুকে আর বের হননি। তার ধারণা ‘খাসোগির সঙ্গে দূতাবাসে অপ্রীতিকর কিছু ঘটেছে’।

কিন্তু সৌদি দূতাবাস দাবি করে, ‘খাসোগি খুব অল্প সময় তাদের ওখানে ছিলেন। প্রয়োজনী কাজ সেরে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়।’

এদিকে তুরস্ক জানায়, তারা বিষয়টি গুরুত্বর সঙ্গে দেখছে ‘খুব শিগগিরই আসল ঘটনা সবাইকে জানাতে পারবে’।

৮ অক্টোবর: সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের ছোট ভাই এবং যুক্তরাষ্ট্রে সৌদি দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত প্রিন্স খালেদ বিন সালমান জোর দাবি করেন যে, খাসোগিকে তাদের দূতাবাসে হত্যা করা হয়নি। তাদের ওপর মিথ্যা দায় চাপানোর চেষ্টা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘জামাল খাসোগি সৌদি নাগরিক। তিনি দূতাবাস থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হয়েছেন।’

এদিকে তুরস্কের কর্তৃপক্ষ সরাসরি কোনো কথা বলেনি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম তাদের সূত্র দিয়ে দাবি করে খাসোগিকে সৌদি দূতাবাসে হত্যা করার পর লাশ গুম করা হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেন, ‘তিনি খাসোগিকে বন্ধুর মত দেখেন। তুর্কী তদন্ত সংস্থাকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন।’

১৫ অক্টোবর: বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম তুরস্কের বরাত দিয়ে খাসোগি হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ও অডিও ফুটেজ আছে বলে সংবাদ পরিবেশন করে। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার নিন্দার মাঝে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরবের বাদশাহ সালমানের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। এরপর তিনি সংবাদমাধ্যমে বলেন, সৌদি আরব খাসোগিকে হত্যা করেনি। কোনো ‘পেশাদার গোষ্ঠী তাকে হত্যা করতে পারে।’

ট্রাম্প তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওকে সৌদি আরব ও তুরস্কে পাঠান। এবং তিনি জানান, পম্পেও তাকে কী ঘটেছে সেটা জানাবেন।

বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যম, দেশ ও ব্যবসায়ীরা সৌদি আরবে হতে যাওয়া সম্মেলন বয়কটের ঘোষণা দেয়। সেই সাথে সৌদি আরবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ারও ঘোষণা আসে বিভিন্ন স্থান থেকে।

আগের মতোই তুরস্কের পুলিশ ও তদন্তকারীদের সূত্র দিয়ে খাসোগি হত্যাকাণ্ডের তথ্য দিয়ে সংবাদ প্রচার করতে থাকে গণমাধ্যম। এক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বরাবরই চুপ ছিলেন।

২০ অক্টোবর: নানা চাপের মুখে এ পর্যায়ে সৌদি আরব স্বীকার করে যে জামাল খাসোগি তাদের দূতাবাসেই খুন হয়েছে। দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেয়া এক বিবৃতিতে দেশটির আইন কর্মকর্তা জানান, ‘খাসোগি তাদের দূতাবাসে গিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন, একপর্যাযে তিনি খুন হন।’

তবে খাসোগির মৃতদেহ কী করা হয়েছে সে বিষয়ে কিছুই জানায়নি সৌদি আরব।

পরদিন ২১ অক্টোবর দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জুবায়ের ফক্স নিউজকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেন, খাসোগি হত্যাকাণ্ডটি ছিল ‘বড় ধরনের ভুল’। তিনি বলেন, ‘আমরা এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করবো।’

এদিকে সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স তুরস্কের প্রেসিডেন্টের এরদোয়ানের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। তিনি এরদোয়ানকে তদন্তের স্বার্থে একে অপরকে সহযোগিতা করার কথা বলেন।

খাসোগি হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি তুর্কী প্রেসিডেন্ট অবিশ্বাস্য রকমের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন উল্লেখ করে হুররিয়াত ডেইলির কলামিস্ট আব্দুল কাদির সেলভি বলেন, ‘এরদোয়ান প্রশাসন সবসময় সংবাদমাধ্যমে কৌশলে সংবাদ দিয়েছে। যেমন কখনো তারা বলেছে, খোসোগি কে হত্যার পর গানের তালে তালে তাকে ১৫ টুকরা করা হয়। বিষয়টি জানার পর স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মাঝে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।’

তুরস্কের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপদেষ্টা জসুয়া ওয়াকার বরাত দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, এই তুর্কী নেতা গণমাধ্যমকে টুকরো টুকরো খবর দিয়ে আন্তর্জাতিক ইস্যু করে তুলেছে। আর তাতে তিনি সফলও হয়েছেন।

সংবাদমাধ্যমটির খবরে আরও বলা হয়, তুরস্ক খাসোগি ইস্যুতে সঠিক পথেই হেঁটেছে, যার কারণে সত্য বিষয়টি বেরিয়ে আসছে।