আগস্টের শেষ দিকে লাউয়াছড়া বন ছেড়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে বিশাল আকৃতির একটি অজগর। সাপটি দেখার পর মেরে ফেলার উদ্যোগ নেয় স্থানীয়রা। এর মধ্যেই খবর চলে যায় বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন’ এর কাছে। ফাউন্ডেশন সংশ্লিষ্টরা ঘটনাস্থলে গিয়ে মধ্যরাতে অজগরটি উদ্ধার করেন।

wildlife going to die

অজগরটি সেদিন উদ্ধার করা গেলেও বেশির ভাগ সময়ই তা সম্ভব হচ্ছে না। লোকালয়ে ঢুকলেই আক্রান্ত হচ্ছে এসব বন্যপ্রাণী। অনেক ক্ষেত্রে মারা পড়ছে। যানবাহনের চাকায়ও পিষ্ট হয়ে মারা যাচ্ছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে লোকালয়ে চলে আসা অনেক প্রাণী।

বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ শাখার হিসাব বলছে, লাউয়াছড়া বনের ভেতর ও আশপাশ এলাকা থেকে চলতি বছরের প্রথম আট মাসে উদ্ধার করা হয়েছে ৫০টি বন্যপ্রাণী। এর মধ্যে সাতটি মৃত। ২০১৭ সালে উদ্ধার করা ১৮৭টি বন্যপ্রাণীর মধ্যে মৃত পাওয়া যায় ১৬টি। তবে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে সবচেয়ে বেশি বন্যপ্রাণী মারা পড়ে ২০১৬ সালে। ওই বছর মোট ২৩০টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ৪৭টিই ছিল মৃত।

wildlife going to die

অবশ্য বন বিভাগের হিসাবের কয়েক গুণ বেশি বন্যপ্রাণী প্রতি বছর মারা পড়ছে বলে দাবি লাউয়াছড়া বন ও বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করা বেসরকারি বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের।

তাদের মতে, বন্যপ্রাণী মারা যাওয়ার খুব কম তথ্যই বন বিভাগের কাছে যায়। এলাকাবাসী ভয়ে বন বিভাগকে এসব তথ্য দিতে চায় না।

বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের হিসাবমতে, গত ছয় মাসে লাউয়াছড়ার আশপাশে অন্তত ২০টি বন্যপ্রাণী মারা গেছে। এর মধ্যে রয়েছে মায়া হরিণ, অজগরসহ বিভিন্ন প্রজাতির সাপ ও বানর। চলতি বছর ফাউন্ডেশনটি বন থেকে লোকালয়ে ঢুকে পড়া ৪০টি প্রাণী আহত ও সুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করেছে। এর মধ্যে কিছু প্রাণী গত ৫ জুন লাউয়াছড়ায় অবমুক্ত করা হয়। ১২টি বন্যপ্রাণী এখনো ফাউন্ডেশনের কাছে রয়েছে, পরবর্তী সময়ে যেগুলো অবমুক্ত করা হবে।

wildlife going to die 1

লাউয়াছড়ায় বন্যপ্রাণী মারা পড়ার মূল কারণ হিসেবে খাদ্য ও আবাস সংকটকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, খাদ্য ও আবাস সংকটে লোকালয়ে এসে উঠছে বনের প্রাণী। এর বড় অংশই পরে মানুষের হাতে মারা পড়ছে।

মৌলভীবাজারের ১ হাজার ২৫০ হেক্টর জমি নিয়ে লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চল। ১৯৯৬ সালে এটিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। উদ্ভিদ ও প্রাণিবৈচিত্র্যের আধার এ বনের ভেতর দিয়ে গেছে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রেলপথ। বনের ভেতরে আছে সড়কপথও। এ দুই পথে ট্রেন আর গাড়ির চাপায় পিষ্ট হয়েও মারা যাচ্ছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বন্যপ্রাণী। আহত হচ্ছে আরও বেশি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে বন্যপ্রাণীর খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। ঝড়ে বড় গাছ উপড়ে পড়ায় বৃহৎ আকৃতির প্রাণীর আবাস সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়া বনের গা ঘেঁষে, অনেক ক্ষেত্রে বনের জমি দখল করে ঘরবাড়ি ও দোকানপাট নির্মাণ, পর্যটকদের বনের ভেতর নির্বিচার প্রবেশ করে হই-হুল্লোড় ও বনের ভেতর দিয়ে যানবাহন চলাচলের কারণেও প্রাণীদের নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র সঙ্কুচিত এবং পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে।

 গবেষক তানিয়া খান বলেন, বন্যপ্রাণী তো লোকালয়ে আসতে চায় না। আমরাই বন-জঙ্গল ধ্বংস করে তাদের আবাসস্থলে নিজের আবাস গড়ছি। গাছ কেটে কাঠ পাচার করছি। ফলে তাদের আবাস ও খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। এ কারণে তারা লোকালয়ে চলে আসছে। নিজেদের প্রয়োজনেই যে এদের রক্ষা করা দরকার, সে সচেতনতা এখনো মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে তৈরি হয়নি। ফলে লোকালয়ে আসা বন্যপ্রাণী অনেকেই মেরে ফেলছে।

লাউয়াছড়া বন নিয়ে কাজ করা বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে জাতীয় উদ্যান ঘোষণার পর এ পর্যন্ত লাউয়াছড়ার প্রায় ৩০ শতাংশ গাছ কমেছে। এর বেশির ভাগ চোরাকারবারিরা কেটে নিয়ে গেছে। এছাড়া ঝড়ে উপড়ে পড়েছে কিছু। গাছ পাচার রোধে কার্যকর পদক্ষেপের অভাব ও নতুন করে বনায়নের উদ্যোগ না নেয়ায় কমছে গাছগাছালি। সংকটে পড়ছে বন্যপ্রাণী।

লাউয়াছড়ায় বন্যপ্রাণীর খাদ্য ও আবাস সংকটের কথা স্বীকার করছে বন বিভাগও। সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) আবু মুছা সামছুল মোহিত চৌধুরী বলেন, খাদ্য ও আবাস সংকটে লোকালয়ে এসে অনেক বন্যপ্রাণী মারা পড়ছে। এ সংকট নিরসনে বনাঞ্চলে বিভিন্ন জাতের ফলমূলের গাছ লাগানোর পাশাপাশি বড় গাছ সংরক্ষণ করা হবে। এছাড়া উদ্যানের ভেতর বন্যপ্রাণীর জন্য একটি রেসকিউ সেন্টার করা হয়েছিল। লোকবলের অভাবে সেটি বন্ধ আছে। এটিও চালু করা হবে। বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তায় বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া রেললাইন ও সড়কপথের বিকল্প চিন্তা করাও প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

 বন বিভাগের হিসাবমতে, লাউয়াছড়া বনে ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৫৯ প্রজাতির সরীসৃপ (৩৯ প্রজাতির সাপ, ১৮ প্রজাতির লিজার্ড ও দুই প্রজাতির কচ্ছপ), ২২ প্রজাতির উভচর, ২৪৬ প্রজাতির পাখি ও অসংখ্য কীট-পতঙ্গ রয়েছে। বিরল প্রজাতির উল্লুক, মুখপোড়া হনুমান ও চশমাপরা হনুমানও দেখা যায় সংরক্ষিত এ বনে। এর বাইরেও রয়েছে বানর, মেছোবাঘ, বন্য কুকুর, ভালুক, মায়া হরিণ, বনছাগল, কচ্ছপ, অজগরসহ নানা প্রজাতির প্রাণী। পাখির মধ্যে আছে সবুজ ঘুঘু, বনমোরগ, মথুরা, তুর্কি বাজ, সাদা ভ্রু সাতভায়ালা, ঈগল, হরিয়াল, কালো মাথা টিয়া, কালো ফর্কটেইল, ধূসর সাতশৈলী, পেঁচা, ফিঙে, লেজ কাটা টিয়া, কালোবাজ, হীরামন, কালো মাথা বুলবুল ও ধুমকল। সাধারণ দর্শনীয় পাখির মধ্যে উল্লেখযোগ্য টিয়া, ছোট হরিয়াল, সবুজ সুইচোরা, তোতা, ছোট ফিঙে, সবুজ কোকিল, পাঙ্গা ও কেশরাজ।

বিপন্ন ও বিরল প্রজাতির অনেকগুলোর অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা। বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া রেলপথ ও সড়কপথকেই বন্যপ্রাণীর জন্য মরণফাঁদ হিসেবে মনে করেন লাউয়াছড়া বন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক জলি পাল। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই বনের মধ্য থেকে সড়ক ও রেলপথ স্থানান্তরের দাবি জানিয়ে আসছি আমরা। এগুলো স্থানান্তর করা না গেলে কোনোভাবেই বন্যপ্রাণী রক্ষা করা যাবে না। আর লাউয়াছড়ার ভেতর বন বিভাগের একটি রেসকিউ সেন্টার থাকলেও সেটি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। এটি চালু থাকলে বন্যপ্রাণী মৃত্যুহার অনেকটা কমে যেত।

নুরুল ইসলাম ইউএনবি।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.