ফখর জামান: যুদ্ধজাহাজ থেকে ক্রিকেট-রণাঙ্গনে আসার গল্প
- Details
- by খেলাধুলা ডেস্ক
বছর কয়েক আগেও হয়তো পাকিস্তান দলের কোনো খেলা থাকলে ফখর জামানকে ছুটতো হতো তার ক্যাপ্টেনের কাছে। ক্যাপ্টেন মানে ক্রিকেট অধিনায়ক নয়, বরং যুদ্ধজাহাজে তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। জাতীয় দলের খেলা দেখার জন্য তাকে নিতে হতো অনুমতি। সেই অনুমতি মিলে গেলে বসতো হতো জাহাজের ডেকে। সেই জাহাজ হয়তো তখন প্রদক্ষিণ করতো আরবসাগর ঘেষা পাকিস্তানের ৬৫০ কিলোমিটারের সমুদ্রঅঞ্চল।
কিন্তু ভাগ্যের ম্যাজিকে ফখর এখন আর যুদ্ধজাহাজের নিবেদিত প্রাণ নন। তার প্রাণমনজুড়ে এখন শুধুই ক্রিকেট। এখন খেলা দেখার জন্য ক্যাপ্টেনের অনুমতি নিতে হয় না তাকে। তার ক্যাপ্টেনই বরং দেশের সমুদ্রসীমা রক্ষণের কাজ করতে করতে জাহাজের ডেকে বসে দেখেন তার খেলা!
হ্যা, ফখর জামান পাকিস্তানের নৌবাহিনী থেকেই উঠে এসেছেন ক্রিকেটের রণাঙ্গনে। যুদ্ধজাহাজের অসীম সাহসের দিনগুলোকে তিনি নিয়ে এসেছেন ২২ গজের উত্তপ্ত ময়দানে। যেখানে সাহসের একটা অসাধারণ প্রদর্শনী দেখালেন ২০ জুলাই।
পাহাড়-পর্বতঘেরা জিম্বাবুয়ের মাটিতে হয়তো খুব বেশি পাকিস্তানির আনাগোনা নেই। তারপরও সেখানেই দেশের নামটা কী দুর্দান্তভাবে তুলে ধরলেন ফখর। পাহাড়ঘেরা অঞ্চলে যেভাবে সাহসের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠতে হয়। বুলাওয়েতে ২০ জুলাই ঠিক তাই হয়ে উঠেছিলেন ফখর। সেই ১৯৯৭ সালে সাঈদ আনোয়ার ভারতকে কাঁপিয়ে করেছিলেন ১৯৪ রান। পাকিস্তানের হয়ে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রানের সেই ইনিংস আর কেউ পেরিয়ে যেতে পারেনি।
সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সেই ইনিংসকে অতীত বানিয়ে দিলেন ফখর জামান। পাকিস্তানের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে তুলে নিলেন ডাবল সেঞ্চুরি। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ফখর জামানের ইনিংসটির মাহাত্ম্য অবশ্য এটুকুই নয়।
ম্যাচ শেষে ফখর বলেছেন দিনটা তার ছিলো বলেই এই কীর্তি গড়তে পেরেছেন তিনি। সঙ্গে আরো বলেছেন, কোচ মিকি আর্থারই নাকি বলেছিলেন ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকাতে। মাঠে ফখর কোচের নির্দেশটাই কেবল পালন করেছেন! যেনো ইচ্ছে করেই প্রথম পাকিস্তানি হিসেবে ডাবল সেঞ্চুরিটা করেছেন তিনি!
বেধে দেয়া লক্ষ্যের পেছনে কিভাবে ছোটেন ফখর, তার একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন পাকিস্তানের ব্যাটিং কোচ গ্রান্ড ফ্লাওয়ার। তিনি বলেন, ‘কোনো কোনো কোচ খেলোয়াড়দের লক্ষ্য বেঁধে দিতে পছন্দ করেন। সেই লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে কেউ কেউ দারুণ খেলেন এবং কেউ চাপে ভেঙে পড়েন। আমরা দেখলাম ফখর হলো সেই ধরনের খেলোয়াড়, যে চাপেই বেশি ভালো খেলে।’
শুক্রবার ২১০ রানের অবিশ্বাস্য ইনিংসটি খেলার পথে ২৯ টি বাউন্ডারি মেরেছেন ফখর। যা ওয়ানডের এক ইনিংসে কোনো পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ বাউন্ডারির রেকর্ড। এই রেকর্ডটা করতে করতেই পাকিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাসে নিজের নামটা অক্ষয় কালিতে লিখে ফেলেন তিনি। পাকিস্তানের আরো অনেক ব্যাটসম্যান হয়তো ডাবল সেঞ্চুরি করবেন, কিন্তু প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটা আর কেউ করতে পারবে না। সেটা যে সম্ভবই নয়!
পাঁচ বছর ধরে পাকিস্তানের ব্যাটিং কোচের দায়িত্ব পালন করছেন গ্রান্ড ফ্লাওয়ার। ফখর জামানের উত্থানের শুরুটা হয়েছে তার চোখের সামনেই। সুতরাং ফখরকে জানতে ফ্লাওয়ারের মূল্যায়নটাও জানা দরকার। পাকিস্তানের ব্যাটিং কোচ বলেন, ‘ওকে নিয়ে নেটে প্রচুর কাজ করেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে ফখরের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তার সহজাত ব্যাটিং সক্ষমতা। ও যখন পাকিস্তানের ওয়ানডে পরিকল্পনায় আসে, তখন ও একেবারেই অদক্ষ ছিলো। কিন্তু সহজাত ক্ষমতা ওকে এগিয়ে দিয়েছে। ওর ব্যাটিং প্রতিভা সাধারণ নয়।’
টিনেজার থাকতেই পাকিস্তানের মারদানের উত্তরাঞ্চল থেকে করাচিতে যেতে হয় ফখরকে। বাবার আদেশে যোগ দেন নৌবাহিনীতে। তার জীবনটা তাই কেটে যেতে পারতো জাহাজে জাহাজেই। কিন্তু ভাগ্যের ম্যাজিক যে লেখা ছিলো অন্যভাবে। নৌবাহিনীতেই তিনি নাজিম খানের দৃষ্টিতে পড়েন। তিনি হলেন পাকিস্তান নৌবাহিনী ক্রিকেট একাডেমির কোচ।
সেই একাডেমির এক ম্যাচে সুযোগ পেয়েই সেঞ্চুরি হাঁকান ফখর। সেখান থেকে করাচি অনূর্ধ্ব-১৯ এক টুর্নামেন্টে সুযোগ পাওয়ার পর তার ব্যাটসম্যান সত্তার আরো প্রকাশ ঘটে এবং জীবনের সবচেয়ে বড় মোড়ে এসে দাঁড়ান তিনি।
নৌবাহিনীতে নাবিক পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন ফখর। সেই পদ ছেড়ে পেশাদার ক্রীড়াবিদ হিসেবে আবার নৌবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। এটা ১০ বছর আগের কথা। কিন্তু পেশাদার ক্রিকেটে পা ফেলতে ফেলতে তার লেগে যায় আরো সাত বছর। ২০১৬-১৭ মৌসুমের কায়েদ-ই-আজম ট্রফিতে খেলেন তিনি। এরপর পাকিস্তান সুপার লিগেও দেখান ঝলক। সেখান থেকে পাকিস্তান টি-টোয়েন্টি দল হয়ে ওয়ানডের আঙিনায় পা পড়ে ফখরের।
ফখরের মানসিকতায় যে দৃঢ়চেতা চরিত্র লুকিয়ে আছে, তাতে প্রভাব ফেলেছে তার নৌবাহিনীর জীবন। সেখানেক অত্যন্ত শৃঙ্খলার মধ্যে থাকতো হতো তাকে। প্রতিদিন ভোরে উঠে দৌড়াতে হতো মাইলের পর মাইল। সন্ধ্যার আগে মিলতো খেলাধুলার সামান্য সুযোগ। ওই সুযোগটাই কাজে লাগাতেন ফখর। রেকর্ড ভাঙার শক্তিটা তার রক্তে ঢুকে যায় সেখানে থাকতেই।
গ্রান্ড ফ্লাওয়ার মনে করেন, নৌবাহিনীতে থাকতে ফিটনেসে যে পাথরকঠিন দৃঢ়তা পেয়েছেন ফখর, তা তাকে সাহায্য করছে ক্রিকেটেও। তিনি বলেন, ‘অবশ্যই ফখরের নাবিক জীবন তার পুরো জীবনে প্রভাব ফেলছে। সে শারীরিকভাবে শক্তসামর্থ্য। ২০০ রান করতে এটার বিশেষ প্রয়োজন আছে। ডাবল সেঞ্চুরি করার পথে কয়েকটি শটে সে আউট হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু ভাগ্য তার সহায় ছিলো। আসল কথা হলো, আপনি যখন সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী থাকবেন, ভাগ্য তখন আপনাকে সহায়তা দিবেই।’
ফখর জামানে টেকনিক নিয়ে খুব কথা হচ্ছে। ব্যাটিংয়ের সময় দৃঢ়তাপূর্ণ ভারসাম্যের জন্য যা দরকার, ফখর হয়তো তা অনুসরণ করে খেলেন না। তারপরও গ্রান্ড ফ্লাওয়ার তার ব্যাটিংয়ে খুব বেশি পরিবর্তন আনতে নারাজ। তিনি বরং মনে করেন, ফখর তার সহজতা সক্ষমতা কাজে লাগিয়েই আধুনিক ক্রিকেটের ভয়ঙ্করতম ব্যাটসম্যান হয়ে উঠুক।
ফখর সামনের দিনগুলো কেমন হতে পারে? এখনো ২০ ওয়ানডেও খেলেননি ফখর। এর মধ্যেই তাকে মনে করা হচ্ছে ভবিষ্যত ক্রিকেটের সুপারস্টার হিসেবে। এমন সময়ে তাকে নিয়ে ফ্লাওয়ার বললেন, ‘আশা করি ফখরের মাথা মাটির দিকেই থাকবে এবং সে কঠোর পরিশ্রমের মানসিকতা ধরে রাখবে। তাহলেই আশা করি সেটা হয়ে যাবে।’
‘সেটা’ বলতে এখানে কী বোঝালেন ফ্লাওয়ার? ফখর শব্দটি উর্দু। যার বাংলা হলো গৌরব। গ্রান্ড ফ্লাওয়ার কি ফখর জামানের পাকিস্তানের গৌরব হয়ে উঠার দিকেই ইঙ্গিত করলেন? তা অবশ্য এখন করাই যায়!
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.