দল পর্যালোচনা: হট ফেভারিট ব্রাজিলের ‘হেক্সা’ মিশন

রক্তে যাদের ফুটবলের নেশা; ফুটবলে তাদের খাওয়া-দাওয়া, ঘুম-নিদ্রা, হাসি-কান্না সবকিছুই। এই ফুটবলকে পুঁজি করেই বিশ্ব মানচিত্রে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে সাম্বা নৃত্যের দেশ ব্রাজিল। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল দলও তারা। সর্বোচ্চ পাঁচবার শিরোপা জিতেছে সেলেকাওরা।

ব্রাজিলিয়ানদের স্বপ্নের সঙ্গে মিশে আছে বড় দুটি দুঃস্বপ্নও। ১৯৫০ সালে ঘরের মাঠে উরুগুয়ের কাছে জেতা ম্যাচ হেরে যাওয়া এবং অতঃপর মারাকানা ট্রাজেডি। সেই দুঃস্মৃতির ক্ষতে প্রলেপ দিতে চার বছর আগে আরেকবার বিশ্বমঞ্চ সাজিয়েছিল ব্রাজিল। এবার তারা উপহার পেল আরো বড় দুঃস্বপ্ন। বেলো হরিজন্তের সেমিফাইনালে জার্মান বুল্টেজারে ৭-১ গোলে পিষ্ট হয়ে লজ্জার এক ইতিহাস গড়ে সেলেকাওরা।

মারাকানা ট্রাজেডি ৬৮ বছর তাড়িয়ে বেরিয়েছে ব্রাজিলিয়ানদের। সেই দুঃস্মৃতি পেছনে ফেলল বেলো হরিজন্তে ট্রাজেডি। দুটো ঘটনা ভুলতে এই মুহূর্তে আরেকটা শিরোপা খুব করে চাইছে ব্রাজিল। জার্মান-ধাক্কাটা গত কয়েক বছরে সামলে নিয়েছে সেলেকাওরা। এ বছরের শুরুর দিকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানিকে হারিয়ে ভুতুড়ে সেই ম্যাচের ভয়টাও কাটিয়ে উঠেছে সাম্বার দেশটি।

ধীরে ধীরে ব্রাজিল ফুটবল ফিরে এসেছে চেনা ছন্দে। ব্রাজিলের পায়ের তলার মাটি এতটাই শক্ত হয়েছে যে, আজ থেকে শুরু হওয়া রাশিয়া মহাযজ্ঞে তাদের ভাবা হচ্ছে অন্যতম ফেভারিট হিসেবে। গত চার বছরে সেলেকাওরা কতটা বদলেছে এটা বোঝাতে এই তথ্যটাই যথেষ্ঠ। তাই গত বিশ্বকাপ ভুলে আবারো হেক্সা (ষষ্ঠ শিরোপা) মিশন শুরু করতে যাচ্ছেন নেইমার-মার্সেলো-সিলভারা।

বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন ব্রাজিল। এটার পেছনে আরো শক্ত একটা যুক্তি আছে। ব্রাজিলই একমাত্র দল যে, যারা সবকটি বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছে। এমন একটা দলকে নিয়ে বিশ্বমঞ্চে আলাদা আবেদন তৈরি হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। তা ছাড়া এই দলের স্বপ্নসারথি হিসেবে আছেন বিশ্বের সবচেয়ে দামি ফুটবলার এবং এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার নেইমার।

ব্রাজিল ফুটবলের এই বদলে যাওয়ার কারিগর টিটে। এই কোচ দায়িত্ব নেওয়ার পর পুনর্জন্ম হয় ব্রাজিলের। টিটের অধীনে নেইমার-জেসুসরা হয়ে উঠেছেন অপ্রতিরোধ্য। ২০১৪ বিশ্বকাপের পর ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে র‌্যাঙ্কিং কুড়ি নাম্বারে নেমে যাওয়া ব্রাজিল কয়েক মাস আগেও শীর্ষে উঠেছিল। তবে আপাতত চূড়ার দল জার্মানির পেছনে আছে সেলেকাওরা।

শুধু বিশ্বকাপই নয়, ফিফার আরেক টুর্নামেন্ট কনফেডারেনস কাপের ইতিহাসেও সবচেয়ে সফল দল ব্রাজিল। রেকর্ড সর্বোচ্চ চারবার মহাদেশীয় সেরাদের টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে পেলে, রোনালদো, জিকো, সক্রেটিস, রিভালদোদের দেশ। এ ছাড়া আমেরিকা মহাদেশের বিশ্বকাপ খ্যাত ‘কোপা আমেরিকা’ টুর্নামেন্টে ৮ বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরবটা আছে ব্রাজিলিয়ানদের।

ব্রাজিল ফুটবলে একটা জায়গায় শুধু হাহাকার ছিল। তা হলো অলিম্পিকের শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে দাঁড়াতে না পারা। দুই বছর আগে রিও অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জিতে সাফল্যের বৃত্তটাও পূর্ণ করে ফেলেছে ব্রাজিল। ঘরের মাঠে জার্মানিকে হারিয়ে গত বিশ্বকাপের কিছুটা হলেও প্রতিশোধ নিয়েছিলেন নেইমার অ্যান্ড কোং।

যুগ যুগ ধরে বিশ্ব ফুটবলকে মোহিত করে আসছে ব্রাজিল। চেনা ফুটবলশৈলিটা ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে ফেললেও চেনা ছন্দে ফিরেছে ব্রাজিল। নেইমার, জেসুস, ক্যাসেমিরোরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন তাদের পূর্বসুরীদের। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে কখনোই যেপ্রতিভার অভাব পড়ে না সেটা তারা ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিচ্ছেন।

আগের আসরের বিপর্যস্ত দলটি এবার অনন্য। সবার আগে রাশিয়ার বিমানের টিকিট কেটেছে সেলেকাওরা। ‘হেক্সা’ মিশন সফল করতে বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে সবার আগে কন্ডিশনিং ক্যাম্প করেছে টিটের দল।

১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৭০, ১৯৯৪ এবং ২০০২। ব্রাজিলের পাঁচটি বিশ্বকাপ জয়ের সাল এগুলো। এর সঙ্গে এবার ২০১৮ যোগ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ব্রাজিল। ষষ্ঠ বিশ্বকাপে এসেই প্রথমবার শিরোপা জিতেছিল সেলেকাওরা। ১৯৫০ সালে তো ট্রফির খুব কাছে গিয়েও সেটা হাতে তুলতে পারেনি ব্রাজিলিয়ানরা।

ষষ্ঠ শিরোপা অভিযান শুরুর আগে সম্ভাব্য সেরা প্রস্তুতিই সেলে ফেলেছে ব্রাজিল। প্রীতি ম্যাচের তিনটিতেই জয় তুলে নিয়েছে সেলেকাওরা। ইনজুরি কাটিয়ে মাঠে ফিরে টানা দুই ম্যাচে গোল করেছেন নেইমারও। তার পায়ের ইনজুরিই গেল তিন মাস ভালোই উৎকণ্ঠায় রেখেছিল গোটা বিশ্বকে। সার্জারি পরবর্তী নির্বাসন শেষে নেইমার যেভাবে ফিরে এলেন তাতে তার মধ্যে দারুণ কিছুর তাড়ানাটা বোঝা যাচ্ছে।

অথচ সংশয়ই দেখা দিয়েছিল নেইমারের বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ নিয়ে। শঙ্কার কালো মেঘ কাটিয়ে পিএসজি স্ট্রাইকার জাতীয় দলে ক্যাম্পে ফিরে এলোও ইনজুরি কারণে আবার ছিটকে যেতে হয়েছে রক্ষণভাগের সারথি দ্যানি আলভেজকে। চোট নিয়ে শেষ মুহূর্তে আবার ছিটকে গেছেন ফ্রেড। দুটি খবর দুঃসংবাদ হয়ে উঠলেও দলে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছেন ব্রাজিল কোচ টিটে।

কারণ তার কাছে অনেক ঐচ্ছিকতা আছে। দলের প্রায়সব শিষ্যই আছেন সেরা ফর্মে। টিটেকে একাদশ গঠন করতেই মধুর সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ব্রাজিলের বর্তমান দলটাকে এই বিশ্বকাপের সেরা দুটি দলের একটি। নেইমারকে ছাড়াই স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে ব্রাজিল। ভারসম্যের এই দলটাই এখন স্বপ্ন দেখাচ্ছে সাম্বার দেশটিকে।

১৭ জুন সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষের ম্যাচ দিয়েই স্বপ্নযাত্রা শুরু করবে ব্রাজিল। ‘ই’ গ্রুপে সেলেকাওদের অন্য দুই প্রতিপক্ষ কোস্টারিকা ও সার্বিয়া। বড় কোনো অঘটন ঘটলে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবেই নক আউট পর্বে উঠবে সেলেকাওরা।