বেল-জাদুতে রিয়াল মাদ্রিদের হ্যাটট্রিক

উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে প্রথম দল হিসেবে শিরোপা ধরে রাখার নজির গত মৌসুমেই দেখিয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ। পরপর দুই আসরে চ্যাম্পিয়ন হওয়া জিনেদিন জিদানের দল আরো একটা রূপকথা উপহার দিল। শনিবার কিয়েভের ফাইনালে লিভারপুলকে ৩-১ গোলে হারিয়ে হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করল স্প্যানিশ ক্লাবটি।

দারুণ এই জয়ে টানা দ্বিতীয়বার শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখলেন রোনালদো-বেল-রামোসরা। রিয়াল মাদ্রিদের উৎসবমুখর এই রাতের নায়ক গ্যারেথ বেল। দলের তিন গোলের দুটিই করেছেন ওয়েলস উইঙ্গার। তার দুটো গোলই ফুটবলপ্রেমীদের চোখে লেগে থাকবে অনেক দিন। রিয়ালকে রুপালি ট্রফি উপহার দিয়ে আগামী মৌসুমেও সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে থাকাটা নিশ্চিত করে ফেললেন ‘হান্ড্রেড মিলিয়নম্যান’।

অথচ ক্লাব ফুটবল দুনিয়া ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ও মোহাম্মদ সালাহর ধ্রুপদী একটা লড়াইয়ের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু টুর্নামেন্টের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা এদিন থাকলেন নিষ্প্রভ, নিশ্চিত দুটো গোলের সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করেছেন রোনালদো। পর্তুগিজ উইঙ্গারের হতাশাটা আড়াল হয়ে যায় দ্বিতীয়ার্ধে বদলি হিসেবে মাঠে নামা বেলের জাদুকরি পারফরম্যান্সে।

প্রথম মিসরীয় ফুটবলার হিসেবে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল খেলতে নেমেছিলেন লিভারপুল ফরওয়ার্ড সালাহ। তার নেতৃত্বাধীন আক্রমণভাগ রীতিমতো কোণঠাসা করে তুলেছিল রিয়াল মাদ্রিদকে। চার মিনিটে তিনটি আক্রমণ করে বসেছিল লিভারপুল। অল রেডদের দুর্দান্ত সূচনায় আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন সমর্থকরা। কিন্তু কোনো গোল হওয়ার আগেই আকাশ ভেঙে পড়ে লাল শিবিরে।

২৫ মিনিটে রিয়াল মাদ্রিদ অধিনায়ক সার্জিও রামোসের ভয়ানক ফাউলের শিকার হন সালাহ। স্প্যানিশ ডিফেন্ডার কুস্তিগিরের মতো সালাহকে মাটিতে ফেলে দেন। তাতে মাথায় এবং কাঁধে মারাত্মক চোট পান মিসরীয় ফরওয়ার্ড। ওই মুহূর্তটা রীতিমতো বুক কাঁপিয়ে দিয়েছিল লিভারপুল সমর্থকদের।

প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে দুই মিনিট পর সালাহ মাঠে ফিরেছেন ঠিকই, কিন্তু খেলার অবস্থায় ছিলেন না। কান্নাভেজা চোখে বেরিয়ে গেছেন ফাইনালের মঞ্চ থেকে। সালাহর অশ্রুজল ছুঁয়ে গেছে সমর্থকদেরও। বিস্ময়কর হচ্ছে- এমন বাজে ফাউলের জন্য কোনো শাস্তিই পাননি রিয়াল ডিফেন্ডার রামোস!

হতাশা ভর করেছিল রিয়াল মাদ্রিদ শিবিরেও। কান্নাভেজা চোখে মাঠ ছাড়তে হয়েছে ড্যানিয়েল কারভাহালকে। বলের দখল নিতে গিয়ে সালাহর কয়েক মিনিট পর চোট পেয়েছেন তিনিও। আরো একটি ফাইনাল থেকে ছিটকে যাওয়ার হতাশার ছাপটা স্প্যানিশ রাইট ব্যাকের চোখেমুখেই ছিল স্পষ্ট। সম্ভবত রাশিয়া বিশ্বকাপও শেষ হয়ে গেল কারভাহালের!

সালাহ-মানে-ফিরমিনোর ত্রিমুখী আক্রমণ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিল রিয়াল মাদ্রিদ। পরে ধীরে ধীরে গুছিয়ে ওঠে চ্যাম্পিয়নরা। আক্রমণে যেতে শুরু করেন বেনজেমা-মডরিচ-রোনালদোরা। সালাহ মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে তুলে নেন তারা।

৪২ মিনিটে গোলের দেখাও পেয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ। কিন্তু দারুণ খেলতে থাকা করিম বেনজেমার গোলটা রেফারি বাতিল করে দেন অফসাইডের কারণে। প্রথমার্ধ যেখান থেকে শেষ করেছিল রিয়াল, দ্বিতীয়ার্ধে তারা শুরু করল সেখান থেকেই। দ্বিতীয়ার্ধের দ্বিতীয় মিনিটেই ইসকোর শট প্রতিহত হয় ক্রসবারে।

রিয়াল মাদ্রিদ প্রথম গোলটা পেয়েছে লিভারপুলের জার্মান গোলরক্ষক লরিস ক্যারিয়াসের হাস্যকর ভুলে। বেনজেমার একটু সামনেই ক্রুসের শটটা ধরেছিলেন লিভারপুল গোলরক্ষক। বেখায়ালি মনে ডান দিকে সতীর্থের উদ্দেশ্যে বল ছুড়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেখানেই পা এগিয়ে দিলেন বেনজেমা। ফ্রেঞ্চ স্ট্রাইকারের পায়ে বল লেগে জড়িয়ে যায় লিভারপুলের জালে!

৫১ মিনিটে করা ক্যারিয়াসের ভুলের মাশুল চার মিনিটের মধ্যে দিয়ে দেন সাদিও মানে। হেন্ডারসনের কর্নার থেকে আসা বলটা হেড করেন লভরেন। বল যেয়ে পড়ে মানের পায়ের কাছে, দারুণ এক শটে রিয়ালের জাল কাঁপান সেনেগালের ফরওয়ার্ড। লিভারপুল সমতায় ফেরায় নড়েচড়ে বসেছিল কিয়েভের গ্যালারি। তখনো মাঠে নামেননি জাদুকর গ্যারেথ বেল।

৬১ মিনিটে ইস্কোর বদলি হিসেবে মাঠে নেমেই ঝলক শুরু ওয়েলস অধিনায়কের। মার্সেলোর নিখুঁত ক্রস থেকে বাই-সাইকেল কিক থেকে প্রায় অবিশ্বাস্য গোল করেন বেল। তার এই গোলের সঙ্গে তুলনা হতে পারে সতীর্থ রোনালদো ও কোচ জিদানের গোলের সঙ্গে।

২-১ গোলে পিছিয়ে পড়লেও হাল ছাড়ছিল না লিভারপুল। ৭০ মিনিটে আরেকবার দলের ত্রাণকর্তা হয়ে উঠেছিলেন মানে। কিন্তু তার দুর্দান্ত শটটা লেগে আসে রিয়ালের ডান পোস্টে লেগে। ভাগ্য যেখানে অল রেডদের সহায় হয়নি সেখানে রিয়ালকে দিয়েছে দুহাত ভরে। কারণ ২৫ গজ দূর থেকে বেল যে গোলটা করেছেন সেটাও হয়েছে ক্যারিয়াসের শিশুসুলভ ভুলে। শট ঠেকাতে যাওয়া লিভারপুল গোলরক্ষকের গ্লাভসে বল লেগে জড়িয়ে যায় জালে। এই ‍দুটো ভুলের জন্য ম্যাচ শেষ অঝরে কেঁদেছেন তিনি। ভক্তদের কাছে চেয়েছেন ক্ষমা।

ক্যারিয়াসের ভুলে হওয়া এই দুটি গোলই শেষ পর্যন্ত লিভারপুলের স্বপ্নভঙ্গের জন্য যথেষ্ট হয়ে যায়। কারণ সালাহ মাঠ থেকে উঠে গেলেও তার অভাবটা পূরণ করে দিচ্ছিলেন মানে-মিলনাররা। দুর্ভাগ্যের পাশাপাশি এ দিন বাজে রেফারিংয়েরও শিকার হয়েছে লিভারপুল। কারণ ডি-বক্সে ক্যাসেমিরোর হ্যান্ডবল হওয়ার পর আবেদন করলেও রেফারি তাদের পেনাল্টি দাবি নাকচ করে দেন।

গত পাঁচ মৌসুমে এ নিয়ে চতুর্থবার শিরোপা জিতল রিয়াল মাদ্রিদ। তন্মধ্যে এবার হ্যাটট্রিক। সব মিলিয়ে ইউরোপের শীর্ষস্থানীয় টুর্নামেন্টে ১৩ বার চ্যাম্পিয়ন হলো স্প্যানিশ ক্লাবটি। তবে রোনালদোর জন্য এটা পঞ্চম চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা। এবং তৃতীয় কোচ হিসেবে তিনটি ইউরোপ সেরার মুকুট জিতেছেন জিদান। রিয়াল চ্যাম্পিয়ন হওয়া লিভারপুলের হারানো রাজত্ব উদ্ধারের অপেক্ষাটা আরো বেড় গেল। ১১ বছর পর ফাইনালে উঠলেও ষষ্ঠ ট্রফিটা জেতা হলো না লিভারপুলের।