ফিরে দেখা বিশ্বকাপ ১৯৫৪: ট্রফি জিতেই জার্মানদের জবাব

প্রথম দিকের বিশ্বকাপগুলো প্রতিটিতেই ছিল বিশৃঙ্খলা। বাছাইপর্বের নাটক, টুর্নামেন্টের ফরমেট নিয়ে জটিলতা দেখেছে বিশ্ব ফুটবল। সেই ধারা থেকে কিছুটা হলেও বেরিয়ে এসেছে ১৯৫৪ সালের সুইজারল্যান্ডের বিশ্বকাপ আসর। বড় কোনা বিতর্ক ছাড়াই সফলভাবেই শেষ হয় বিশ্বকাপের পঞ্চম আসর।

আগের বিশ্বকাপগুলোর তুলনায় এই বিশ্বকাপের রোমাঞ্চ ছিল কয়েকগুণ বেশি। পুরো আসরেই দেখা গেছে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ফুটবল। গোলবন্যা, রূপকথা, ঘটন-অঘটন প্রায় সবকিছুর উপদানই ছিল সুইজারল্যান্ড বিশ্বকাপে। যেটার শুরু থেকে অপ্রতিরোধ্য হাঙ্গেরিকে কাঁদিয়ে শেষটা রাঙিয়ে তোলে পশ্চিম জার্মানি।

কোনো বিতর্ক এবং ফুটবল পরাশক্তিদের আপত্তি ছাড়াই সুইজারল্যান্ডে বসে বিশ্বকাপের পঞ্চম আসর। আগের তুলনায় এই আসরের জনপ্রিয়তা যে বেড়েছে সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে অধিক দেশের বাছাইপর্বে খেলার আগ্রহের বিষয়টা। এই আসরের জন্য ৪২টি দল বাছাইপর্বে অংশ নেয়। সেখান থেকে ১৪টি দল চূড়ান্ত করা হয়।

বাছাইপর্বে অঘটনের শিকার হয়ে বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে ইউরোপের দুই জায়ান্ট দল স্পেন ও সুইডেনের। আর্জেন্টিনা আবার অংশ নেয়নি খেলোয়াড়দের মধ্যে বিবাদের জের ধরে। স্বাগতিক হিসেবে সুইজারল্যান্ড এবং ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে সরাসরি মূলপর্বে অংশ নেয় উরুগুয়ে।

অংশগ্রহণকারী ১৬টি দল হচ্ছে- সুইজারল্যান্ড (স্বাগতিক), উরুগুয়ে, ফ্রান্স, ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, চেকোস্লোভাকিয়া, ইংল্যান্ড, হাঙ্গেরি, স্কটল্যান্ড, তুরস্ক, যুগোস্লাভিয়া ও পশ্চিম জার্মানি। এই আসর দিয়ে এশিয়ান দল হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ার অভিষেক ঘটে।

এই দলগুলোকে চারভাগে বিভক্ত করে সাজানো হয় গ্রুপপর্ব। যেটা মঞ্চস্থ হয় রবিন লিগ রাউন্ডে। প্রতি গ্রুপের সেরা দুই দল টিকিট পেয়েছে কোয়ার্টার ফাইনালের টিকিট। তবে পয়েন্ট ব্যবধান সমান হলে প্লে-অফ ম্যাচেরও আয়োজন রেখেছিল ফিফা। শেষ আট থেকেই শুরু হয় নকআউট পর্ব। বলা হয়ে থাকে এটাই বিশ্বকাপের প্রথম আদর্শ ফরমেট।

টুর্নামেন্টের ২৬টি ম্যাচ দেখেছে ১৪০টি গোল! ম্যাচ প্রতি গড় গোল ৫.৪। এই গোলবন্যার কারণে সুইজারল্যান্ড বিশ্বকাপটা অনেক দিন আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল। ১৬ দলের বিশ্বকাপে এর চেয়ে বেশি গোল দেখেনি কোনো আসরই। অথচ আগের দুই আসরে গোল হয়েছে এর অর্ধেক!

নাটকীয় গ্রুপপর্ব থেকে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে ইউরোপের ছয়টি দেশ। ল্যাটিন আমেরিকা থেকে যে দুটি দল অংশ নিয়েছে সেই ব্রাজিল ও উরুগুয়ে ঠিকই প্রত্যাশিতভাবে উঠে দ্বিতীয় রাউন্ডে। তবে ব্রাজিল বিদায় নেয় এই পর্বেই। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নরা ছিটকে যায় সেমিফাইনাল থেকে। ল্যাটিন দুই জায়ান্টই বিদায় নিয়েছে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা পুসকাসের হাঙ্গেরির হাত ধরে।

টানা ৩২ ম্যাচ জিতে রীতিমতো উড়ছিল হাঙ্গেরি। তৎকালীন ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে সেরা দলেও রূপান্তর হয়েছিল তারা। তাদের হাতেই সুইজারল্যান্ড বিশ্বকাপের শিরোপা দেখেছিলেন প্রায় সবাই। ফাইনালে আট মিনিটের মধ্যে দুই গোল করে চ্যাম্পিয়নশিপ প্রায় নিশ্চিতও করে ফেলেছিল হাঙ্গেরি।

ম্যাচের বয়স ১৮ মিনিট হতেই হাঙ্গেরিকে পরপর দুটি গোল ফিরিয়ে দেয় জার্মানরা। শেষ বাঁশির কয়েক মিনিট আগে জয়সূচক গোল করে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায় ক্লোসা-লাম-কানদের দেশ।

কিন্তু বিতর্কের ছায়াটা থাকল এই বিশ্বকাপেও। ইনজুরি কাটিয়ে ফাইনালে ফেরা তখনকার ‘ফুটবলঈশ্বর’ খ্যাত পুসকাস ৮৭ মিনিটে স্কোর লাইন ৩-৩ করেছিলেন। কিন্তু অফসাইড বলে তার সেই গোলটা বাতিল করে দেন রেফারি। রেফারির এই সিদ্ধান্তটাই ফাইনালে তুলেছিল বিতর্কের ঝড়। ফাইনাল শেষে জার্মান ফুটবলাররাও রেফারির ভুলটা স্বীকার করে নিয়েছেন।

ফাইনালের বিতর্ক আরো উস্কে দিয়েছিল চ্যাম্পিয়ন পশ্চিম জার্মানির খেলোয়াড়রা নিষিদ্ধ ড্রাগ নিয়ে খেলতে নামায়। কিন্তু সেই অভিযোগটা হারিয়ে যায় জার্মানদের রূপকথার মধ্যে। অভিযোগ প্রমাণের বদলে উল্টো জয়ধ্বনি ওঠে জার্মানদের পক্ষে। কারণ যুদ্ধবাজ দেশ বলে এই জার্মানিকেই আগের বিশ্বকাপে নিষিদ্ধ করেছিল ফিফা।

সুইজারল্যান্ড বিশ্বকাপে ফিরে সেটার একটা মোক্ষম জবাব ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থাকে দিয়েছিল জার্মানি। বিস্ময়কর হচ্ছে- চ্যাম্পিয়ন জার্মানির ফুটবলারদের তখন কোনো পেশাদার ক্লাবে খেলারও অভিজ্ঞতা ছিল না! অথচ আনকোরা সেই দলটিই অপ্রতিরোধ্য হাঙ্গেরির স্বপ্নটা গুঁড়িয়ে জিতে নিয়েছিল শিরোপা। মজার বিষয় হচ্ছে গ্রুপপর্বে এই জার্মানদেরই ৮-৩ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিল হাঙ্গেরি।