দল পর্যালোচনা: গ্রুপপর্বেই নাইজেরিয়ার অগ্নিপরীক্ষা

আফ্রিকান ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল দল নাইজেরিয়া। বিশ্বমঞ্চে তাদের চিরচেনা প্রতিপক্ষের নাম আর্জেন্টিনা। গত কয়েকটি বিশ্বকাপে দুটো দলের এতবার দেখা হয়েছে যে অন্য কোনা দলগুলোর এমন ঘনঘন মুখোমুখি হওয়ার নজির নেই। আসন্ন রাশিয়া বিশ্বকাপেও দেখা হচ্ছে দল দুটোর, গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে।

এই দ্বৈরথটা একটু বেশিই রোমাঞ্চের জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশি ফুটবলপ্রেমীদের মনে। সাত বছর আগে এই দুটি দল প্রীতি ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। ওই ম্যাচটিতে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না ঢাকার মাঠে। তবে দলীয় লড়াই নয়, আর্জেন্টিনা অধিনায়ক লিওনেল মেসির জাদু দেখতেই স্টেডিয়ামে উপচে পড়েছিলেন বাংলাদেশের ফুটবলপাগল মানুষ।

রাশিয়ার মঞ্চেও পরিচিত দ্বৈরথটা দেখা যাবে গ্রুপপর্বেই। ‘ডি’ গ্রুপে সুপার ঈগলদের অন্য দুই প্রতিপক্ষ আইসল্যান্ড ও ক্রোয়েশিয়া। দ্বিতীয় দলটির বিপক্ষের ম্যাচ দিয়েই ১৬ জুন বিশ্বকাপ অভিযান শুরু করবে আফ্রিকান জায়ান্ট দলটি। তবে প্রতিক্ষীত আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়ার লড়াইটি হবে ২৬ জুন। সেন্ট পিটার্সবার্গের ওই ম্যাচটা হয়ে উঠতে পারে নাইজেরিয়ানদের বাঁচা-মরার উপলক্ষ।

কারণ দ্বিতীয় সবচেয়ে কঠিন গ্রুপে পড়েছে আফ্রিকান দলটি! অন্য দুই ম্যাচে তাদের প্রতিপক্ষ রূপকথার জন্ম দিয়ে বিশ্বকাপে আসা আইসল্যান্ড ও ১৯৯৮ বিশ্বকাপের চমক ক্রোয়েশিয়া। তাই বলা বাহুল্য গ্রুপপর্বের বাধা পাড়ি দেওয়াটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে নাইজেরিয়ার জন্য। এ যাত্রায় দলটিকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন ভিক্টর মোসেজ। দলের সবচেয়ে বড় তারকা বলতে তিনিই।

নাইজেরিয়ার ফুটবল ইতিহাস অনেক প্রাচীন। তবে বিশ্বমঞ্চে অভিষেকের জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হেয়ছিল ১৯৯৪ সাল অবধি। নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপেই রীতিমতো চমক নিয়ে হাজির হয়েছিল আফ্রিকান ঈগলরা। ওই আসরে দুইবারের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে বিশ্বকাপে অঘটনের জন্ম দিয়েছিল নাইজেরিয়া। এর পাশাপাশি গ্রিসের বিপক্ষের জয় তাদের এনে দিয়েছিল নক আউট পর্বের টিকিট।

দুর্দান্ত ছন্দটা পরেরবার ফ্রান্স বিশ্বকাপেও বয়ে এনেছিল নাইজেরিয়া। ১৯৯৮ সালে বুলগেরিয়া ও প্যারাগুয়েকে হারিয়ে গ্রুপপর্বের বাধা পাড়ি দিয়েছিল তারা। কিন্তু এবারো কোয়ার্টার ফাইনালের আগেই থেমে যায় তাদের স্বপ্নযাত্রা। ইতালির পর ডেনমার্কের হাত ধরে বিদায় নিতে হয় আফ্রিকান পরাশক্তিদের।

আফ্রিকান প্রথম দেশ হিসেবে টানা তৃতীয়বার বিশ্বকাপে নাম লিখিয়েছিল নাইজেরিয়া ২০০২ সালে। এই আসরে শেষ ষোলোর প্রাচীর ডিঙানোটাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। কিন্তু রূপকথা যে সবসময় হয় না সেটা তারা বুঝে গেছে জাপান-কোরিয়া বিশ্বকাপে। ইংল্যান্ড, আর্জেন্টিনা ও সুইডেনের মতো দলের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি নাইজেরিয়া। বিদায় নিতে হয় প্রথম রাউন্ডেই।

চার বছরের মধ্যে কঠিন বাস্তবতার শিকার হয় আফ্রিকান দলটি। জার্মানি বিশ্বকাপে তাদের থাকতে হয় দর্শক সারিতে। সেই ব্যর্থতা ঘুচিয়ে ২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে জায়গা করে নেয় সুপার ঈগলরা। কিন্তু নিজেদের মহাদেশে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগটা কাজে লাগাতে পারেনি নাইজেরিয়া। দ্বিতীয় ‘স্বাগতিক’ দলটির স্বপ্নভঙ্গ হয় আর্জেন্টিনার কাছে। এই দলটার কাছে হেরেই শেষবার গ্রুপপর্বে থেমে গিয়েছিল তাদের রথযাত্রা।

কাকতালীয়ভাবে সবশেষ ব্রাজিল বিশ্বকাপেও আর্জেন্টিনার সামনে পড়ে যায় নাইজেরিয়া। তবে গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে ৩-২ গোলে হারলেও আশার সমাধি হয়নি তাদের। ইরানের বিপক্ষে ড্র ও বসনিয়া-হার্জেগোভিনার বিপক্ষের জয় আফ্রিকানদের তুলে দেয় দ্বিতীয় রাউন্ডে। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার সৌভাগ্য আর হয়নি। নক আউট পর্বের শুরুতে এবার তারা থেমেছে ফ্রান্সের কাছে।

শেষ ষোলোর এই বৃত্ত ভাঙার চ্যালেঞ্জ নিয়ে এবারের বিশ্বকাপ অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে নাইজেরিয়া। আসন্ন ফুটবলযজ্ঞে তাদের আশা দেখাচ্ছেন দলের অভিজ্ঞ ফুটবলাররা। যে দুজন খেলোয়াড় দেশের জার্সিতে ম্যাচ সংখ্যায় সেঞ্চুরি ছুঁয়েছেন সেই ভিনসেন্ট এনিয়েমা ও জোসেফ ইয়াবো আছেন দলের স্বপ্ন-সারথি হিসেবে।

এ ছাড়া দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৩৭ গোল করা রাশিদি ইয়াকিনিও ভরসার নাম হয়ে উঠেছেন। তবে নাইজেরিয়ার বিশ্বকাপ অভিযান শুরু করবেন জন ওবি মাইকেলের মতো অভিজ্ঞ ফুটবলারের নেতৃত্বে। প্রধান কোচ গের্মত রোহেও শেষ ষোলোর দেয়াল ভাঙার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেটা তিনি রাখতে পারেন কিনা সেটা পরের কথা, আগে তো গ্রুপপর্বের বাধা পাড়ি দিতে হবে নাইজেরিয়াকে। প্রথম রাউন্ডেই যে অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি আফ্রিকান ঈগলরা!