কোন কোন দেশ মার্কিন ডলার বর্জন করছে এবং কেন?

ইরানের সঙ্গে ব্যবসা করছে এমন ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর অবরোধ আরোপের হুমকি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন ডলারের পরিবর্তে ইউরো মুদ্রায় লেনদন করার বিষয়টি বিবেচনা করছে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ইউরোপের দেশগুলো।

এই পদক্ষেপ ইরানের মতো বিশ্বের একটি অন্যতম বড় বাজার হাতে রাখতে ইউরোপকে সাহায্য করতে পারে। জাতিসংঘের স্থায়ী কমিটির পাঁচ সদস্য ও জার্মানির সঙ্গে করা তেহরানের পরমাণু চুক্তির ফলে ইউরোপের জন্য ইরানের বাজার উন্মুক্ত হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি থেকে সরে গিয়ে ফের ইরানের ওপর অবরোধ আরোপ করলে এই বাজার হুমকির মুখে পড়ে।

মার্কিন ডলারে লেনদেন থেকে সরে আসার পদক্ষেপ এটাই প্রথম নয়। আরো বেশ কয়েকটি দেশ মার্কিন ডলারে আন্তর্জাতিক লেনদেন থেকে সরে আসার কথা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে। ডলার বর্জনের পদক্ষেপ বাস্তবে কী প্রভাব ফেলতে পারে তা নিয়ে আরটি ডটকম বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলেছে।

কম্পিটেন্স ফাইন্যান্স এসএএস-এর সভাপতি আলেজান্দ্রে কাতেব বলেন, পরমাণু চুক্তি বাতিলের পর বর্তমান পরিস্থিতিতে ইরান মার্কিন ডলার ত্যাগে সবচেয়ে বেশি চাপে রয়েছে। দেশটি আগে থেকেই আংশিকভাবে মার্কিন ডলারে লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছে।

একই সময়ে জ্বালানি তেল আমদানির লেনদেনের ক্ষেত্রে নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ান ব্যবহারে পদক্ষেপ নিয়েছে চীন। দেশটির এই পদক্ষেপ মার্কিন ডলারের আধিপত্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

প্রশান্ত মহাসগারীয় অঞ্চলে এফএক্স ট্রেডিং ফর ওএএনডিএ-এর প্রধান স্টেফেন ইনেস বলেন, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে স্বাক্ষরিত দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্যিক চুক্তিগুলো এখন ইউয়ান মুদ্রা ব্যবহারের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে।

তিনি বলেন, এর নেপথ্যে রয়েছে চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ কর্মসূচি। এমনকি ইউয়ানকে এগিয়ে নিতে চীন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পার্শ্ববতী দেশগুলোর জন্য এই মুদ্রা বিনিময়ের সুবিধাকে আরো মধুর করছে।

এদিকে তুরস্ক গত কিছুদিন আগে রাশিয়ার সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্য দুদেশের নিজস্ব মুদ্রায় করার ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং রাশিয়ার সঙ্গে ক্রমশ ঘনিষ্ঠতা তৈরির প্রেক্ষাপটে আঙ্কারা এই পদক্ষেপ নিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে একমত, বিভিন্ন দেশের মধ্যে দ্বি-পাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক চুক্তিগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের ওপর ক্রমহ্রাসমান নির্ভরশীলতার ক্ষেত্রে প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে।

কলরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রামা বাসুদেভান বলেন, এটা অনেকটা নির্ভর করছে উদ্দেশ্য সাধনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া এবং চীনের পদক্ষেপের ওপর। এটা হতে পারে ব্যবসায়িক অংশীদারদের মধ্যে দ্বি-পাক্ষিক ব্যবস্থাপনা ও আঞ্চলিক ব্যবস্থাপনায় বৈচিত্র আনা এবং বহুপাক্ষিক ব্যবস্থাপনায় বিকল্প ঠিক করা যেটা ডলারের আধিপত্যকে টিকিয়ে রেখেছে।

একই সময়ে বিশ্লেষকরা এটা স্বীকার করেন যে, ডলারের লেনদেন থেকে এতো সহজে মুক্তি পাওয়া সহজ নয়। ব্রিটিশ পাউন্ডকে হটিয়ে প্রায় এক শতক ধরে আন্তর্জাতিক রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে মার্কিন ডলার। এর আগে ঊনিশ শতক এবং বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক রিজর্ভ মুদ্রা হিসেবে আধিপত্য ধরে রেখেছিল পাউন্ড।

কাতেবের মতে, ‘নানা কারণে এখনো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং রিজার্ভের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারই পছন্দের মুদ্রা। গোটা আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা মার্কিন ডলারকে ঘিরে এবং মার্কিন ডলারের কেন্দ্রীয় ভূমিকার উপর প্রতিষ্ঠিত।’

অবশ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন আসবে। ভার্চুয়াল কারেন্সি তথা ডিজিটাল মুদ্রা সংক্রান্ত ব্লকচেইন টেকনোলজির দ্রুত অগ্রগতি পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটা শুরু করবে।

কাতেব বলেন, ‘চূড়ান্ত পর্যায়ে বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্যের বিবর্তনের সঙ্গে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থাপনার বিবর্তনও ব্যাপকভাবে জড়িত। এই পরিবর্তন রাতারাতি হবে না। এটা অনেক সময় নেবে এবং অনেক সঙ্কট ও শক্তির ভারসাম্যের পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে সম্পন্ন হবে।’