রাখাইন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন চায় নিরাপত্তা পরিষদ

বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপদে, নিরাপত্তার সাথে, স্বেচ্ছায় ও সম্মানের সাথে নিজ ভূমিতে প্রত্যাবর্তন; এই সমস্যার শিকড় খুঁজে বের করা এবং রাখাইন অ্যডভাইজরি কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দল।

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সাম্প্রতিক সফর নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মে মাসের সভায় যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার এক ব্রিফিংয়ে এ আহ্বান জানায় নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দল।

পোল্যান্ডের সভাপতিত্বে মে মাসের এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পরিষদ প্রতিনিধিদলের গত ২৮ এপ্রিল থেকে পহেলা মে পর্যন্ত রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফরের উপর ব্রিফিং করা হয়।

এসময় নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদল ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত প্রেসিডেন্সিয়াল স্টেটমেন্টের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান। তারা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারকের বাস্তবায়নের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চান। মিয়ানমার সরকার যাতে মিয়ানমার তথা রাখাইনে জাতিসংঘসহ সংশ্লিষ্ট সকল আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদলের অবাধ ও নিরাপদ প্রবেশ এবং বাধাহীন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করে সে বিষয়ের প্রতি এই প্রতিনিধিদল বিশেষভাবে জোর দেন।

এছাড়া শিশু ও নারীসহ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সকল সহিংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার জন্য মিয়ানমারের সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচারের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে উত্থাপনের বিষয়েও জোর দেন কয়েকটি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধি।

ব্রিফিং শেষে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশ চীন, যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন, ফ্রান্স, কাজাখিস্তান, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, রাশিয়ান ফেডারেশন, নেদারল্যান্ডস ও পোলান্ড বক্তব্য রাখে। নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদলের এই পরিদর্শন মিয়ানমার সঙ্কটের বিষয়ে সকলের চোখ খুলে দিয়েছে বলে মন্তব্য করে প্রায় সকল সদস্য দেশ।

নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদলের সাথে মতবিনিময়কারী রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছে বলে মন্তব্য করেন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধি।

নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলো তাদের বক্তব্যে মানবতার বিরুদ্ধে এই ধরনের অপরাধ করে যাতে কেউ পার না পায় তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।

এই সঙ্কট সমাধানে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও জাতিসংঘসহ মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূতের সাথে সামনের দিনগুলোতে নিরাপত্তা পরিষদ আলোচনা অব্যাহত রাখবে বলে সুইডেনসহ কয়েকটি সদস্য দেশ তাদের বক্তব্যে উল্লেখ করেন।

নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশের বাইরে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের স্থায়ী প্রতিনিধি।

ব্রিফিংটি তিনটি পর্বে উপস্থাপিত হয়। কুয়েতের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মনসুর আল ওতায়িবী বাংলাদেশ সংক্রান্ত অংশ, পেরুর স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত গুস্তাভো মেজা কোয়াড্রা মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদো সংক্রান্ত অংশ এবং যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত ক্যারেন পাইয়ার্সি রাখাইন স্টেট সংক্রান্ত অংশটি উপস্থাপন করেন।

কুয়েতের রাষ্ট্রদূত তার ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য উচ্চ পর্যায়ের সরকারি প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক এবং কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের বিষয়ে তথ্য উপস্থাপন করেন। মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নাগরিকদের মানবিক সহযোগিতা ও আশ্রয় প্রদানের জন্য তিনি নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এক্ষেত্রে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য আসন্ন বর্ষা মৌসুমে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করার প্রতি গুরুত্বরোপ করা হয়। তিনি রোহিঙ্গাদের প্রতি সংঘটিত সহিংসতাকে ‘জাতিগত নির্মূল’ বলে অভিহিত করেন।

পেরুর স্থায়ী প্রতিনিধি মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি, সিনিয়র জেনারেল মিন অং হালাইংসহ মিয়ানমার সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকের বিষয়টি তুলে ধরেন।

ব্রিফিংয়ে তিনি জানান, এসকল বৈঠকে নিরাপত্তা পরিষদ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপদে, নিরাপত্তার সাথে, স্বেচ্ছায় ও সম্মানের সাথে নিজ ভূমিতে প্রত্যাবর্তন; এই সমস্যার শিকড় খুঁজে বের করা এবং রাখাইন অ্যডভাইজরি কমিশনের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানায়।

যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধি তার ব্রিফিংয়ে উত্তর রাখাইন প্রদেশের বর্তমান পরিস্থিতি, বিশেষ করে গ্রামের পর গ্রামে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।

ব্রিফিং অনুষ্ঠান শেষে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদেশসমূহ একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন। উল্লেখ্য নিরাপত্তা পরিষদ তাদের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফরের উপর গত ৯ মে একটি প্রেস স্টেটমেন্টও ইস্যু করে। ইউএনবি।