স্নায়ুক্ষয়ী এল ক্লাসিকো: দুই দলই জয় বঞ্চিত

ম্যাচের মিনিটে ছড়িয়ে ছিলো উত্তেজনার রেণু। দুই দলের ফুটবলারদের শরীরী ভাষাতেও ছিলো আগ্রাসন। যা বুঝিয়ে দিয়েছে কেন এই ম্যাচের মর্যাদা অন্য যে কোনো ম্যাচের মতো নয়। স্নায়ুচাপের চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়া রোমাঞ্চকর দ্বৈরথটা শেষ পর্যন্ত অবশ্য অমীমাংসিত থেকেছে ২-২ গোলে।

একটি আদর্শ ম্যাচের প্রায় সব উপাদানই ছিল মৌসুমের শেষ এল ক্লাসিকোতে। আক্রমণ, পাল্টা-আক্রমণ, গোল উৎসব, লাল কার্ড, হাতাহাতি, ধাক্কা-ধাক্কি, প্রাণবন্ত গ্যালারি- কী ছিল না স্প্যানিশ লা লিগার ধ্রুপদী লড়াইটাতে!

লিগ শিরোপার ফয়সালা হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন আগেই। এক মৌসুম বিরতি দিয়ে শিরোপা নিশ্চিত করেছে বার্সেলোনা। লিগের এই দৌড়ে অবশ্য ছিল না রিয়াল মাদ্রিদ। এই এল ক্লাসিকোটা তাই রূপ নিয়েছিলো শুধুই নিয়মরক্ষার ম্যাচে।

রোববার সেই আনুষ্ঠানিকতার ম্যাচটাও সে যে কী বারুদেঠাসা! লিগ হয়তো শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু রোমাঞ্চ এবং উত্তেজনার কমতি ছিল না রিয়াল-বার্সার মহারণে। দুর্দান্ত একটা লড়াই-ই উপহার দিল স্পেনের দুই জায়ান্ট। ন্যু ক্যাম্প দেখল দ্বিতীয়ার্ধে দশ জনের দল নিয়ে খেলা বার্সার দারুণ ড্র। ম্যাচে কাতালান ক্লাবটির জন্য এটি এক বড় প্রাপ্তিই। এই ম্যাচে ভাগ্য ছিলো রিয়ালের পক্ষে। না হলে দুইবার পিছিয়ে থেকেও তারা ড্র নিয়ে কিভাবে ফিরে!

স্নায়ুক্ষয়ী এই ড্রয়ে লিগের চলমান মৌসুমে অপরাজিত থাকার গৌরবটা ধরে রাখল বার্সেলোনা। পরের তিনটি ম্যাচে (ভিয়ারিয়াল, লেভান্তে ও রিয়াল সোসিয়েদাদ) হার এড়ালেই অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হবেন মেসি-ইনিয়েস্তা-সুয়ারেজরা। বার্সা সমর্থকদের জন্য আশার খবর হচ্ছে- তিন ম্যাচের দুটোই দল খেলবে ঘরের মাঠ ন্যু ক্যাম্পে।

ম্যাচটা যে জমজমাট একটা লড়াই উপহার দেবে সেটার ইঙ্গিত মিলেছিল শুরুতেই। লিওনেল মেসিকে আটকাতে গিয়ে দশ মিনিটে গোল হজম করে বসে রিয়াল মাদ্রিদ। সার্জি রবার্তোর ক্রসটা ফাঁকায় পেয়ে দারুণ এক ভলিতে রিয়ালের জাল কাঁপান লুইস সুয়ারেজ।

পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে রিয়ালকে সমতায় ফেরান ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। করিম বেনজেমার মাথা ছোঁয়া বলটাকে বার্সার জালে পাঠান পর্তুগিজ উইঙ্গার। মিনিট দশেকের মধ্যে দ্বিতীয় গোলটি পেতে পারতেন বর্ষসেরা ফুটবলার। কিন্তু রোনালদোর শটটা রুখে দেন বার্সা গোলরক্ষক মার্ক-আন্দ্রে টের স্টেগেন।

২৭ মিনিটে গোলরক্ষককে একা পেয়েও রোনালদো শট মারেন গোলমুখের বাইরে। ততক্ষণে জমে উঠেছে এল ক্লাসিকো মহাযুদ্ধ। বিরতির আগে আরো একবার গোলের সুযোগ হাতছাড়া করেন রোনালদো। গোল মিসের মহড়া দিলেন তার সতীর্থ করিম বেনজেমাও।

প্রথমার্ধে দুটো সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেননি মেসিও। আর্জেন্টাইন সুপারস্টারকে গোলবঞ্চিত করেন রিয়াল গোলরক্ষক কেইলর নাভাস। মেসি দ্বিতীয় গোলটা পাননি কোস্টারিকান তারকার দারুণ দৃঢ়তায়। না হলে ম্যাচ শেষে হাসিমুখে মাঠ ছাড়তে পারতো বার্সেলোনা।

ন্যু ক্যাম্পে শুরু থেকেই বল দখলে ছিল সেয়ানে সেয়ানে লড়াই। এই বলের দখল নিতে গিয়েই দুই দলই হয়ে ওঠে মারমুখী। বার্সার তুলনায় রিয়ালের খেলোয়াড়রাই বেশি আগ্রাসী ছিলেন এই ম্যাচে। পুরো ম্যাচে তারা ফাউল করেছে ১৯টি, সেখানে বার্সার ফাউল ৮টি। ম্যাচটা এতটাই ঝাজালো ছিল যে, মেসি নিজেও ফাউল করে দেখেছেন হলুদ কার্ড!

কিন্তু সুযোগ বুঝে রিয়াল ডিফেন্ডার মার্সেলোকে কনুই দিয়ে আঘাত করার মাশুল দিতে হলো সার্জি রবার্তোকে। রেফারির চোখ ফাঁকি দিতে পারেননি তিনি, প্রথমার্ধের শেষ দিকে লাল কার্ড দেখতে হয় তাকে। তার পরিণতি হতে পারতো রিয়াল অধিনায়ক সার্জিও রামোসেরও।

দ্বিতীয়ার্ধে একজন কম নিয়ে খেলতে নামে বার্সা। ফায়দাটা নিতে পারেনি রিয়াল। উল্টো দশ জনের বার্সাই টুটি চেপে ধরে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের। ততক্ষণে গোড়ালির চোট নিয়ে রোনালদোর জায়গা হয়ে গেছে রিজার্ভ বেঞ্চে। পর্তুগিজ তারকা অবশ্য আশ্বস্ত করেছেন ২৬ মে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালের আগেই ফিট হয়ে উঠবেন তিনি।

অদম্য বার্সেলোনা দ্বিতীয়বার ম্যাচে লিড নেয় ম্যাচের ৫২ মিনিটে। সুয়ারেজের পাস পেয়ে রিয়ালের দুই ডিফেন্ডারকে ঘোল খাইয়ে বাঁ পায়ের ট্রেডমার্ক শটে স্বাগতিকদের উল্লাসে মাতান মেসি। আর্জেন্টিনা অধিনায়ক শৈল্পিক ফুটবলে দ্বিতীয়ার্ধে মাতিয়ে রাখেন গোটা গ্যালারি। রিয়ালের গোলপোস্টের অতন্দ্র প্রহরী নাভাস অতিমানব হয়ে না উঠলে দশ জনের বার্সাকেই মেসি এগিয়ে দিতে পারতেন ৩-১ গোলে।

মেসি গর্জন তুললেও গ্যালারির বড় একটা অংশজুড়ে থাকলেন আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা। কারণটাও অনুমেয়। বিশ্বজয়ী স্প্যানিশ মিডফিল্ডারের এটাই যে ক্যারিয়ারের শেষ এল ক্লাসিকো! ৫৭ মিনিটে পাওলিনহোর জন্য ইনিয়েস্তা যখন মাঠ ছাড়ছিলেন তখন পুরো গ্যালারি দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানিয়ে বার্সা অধিনায়কের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে।

৭২ মিনিটে স্কোর লাইন ২-২ করেন ‘হান্ড্রেড মিলিয়নম্যান’ গ্যারেথ বেল। মার্কো অ্যাসেনসিওর জোগান থেকে বাঁকানো শটে ওয়েলস উইঙ্গার খুঁজে নেন জালের ঠিকানা। চার মিনিট পরই ম্যাচে প্রথমবার এগিয়ে যেতে পারতো রিয়াল। কিন্তু জর্ডি আলবার ট্যাকলে ডি-বক্সে মার্সেলো পড়ে গেলেও রিয়ালের পেনাল্টি দাবি নাকচ করে দেন রেফারি। শেষ কয়েক মিনিটে মুহুর্মুহু আক্রমণ শানিয়েও বার্সার রক্ষণদুর্গে তৃতীয়বার ফাটল ধরাতে পারেনি রিয়াল। তাই এক পয়েন্ট নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় অতিথিদের।

এই ড্রয়ে ৩৫ ম্যাচে ৮৭ পয়েন্ট নিয়ে যথারীতি শীর্ষে আছে বার্সেলোনা। সমান ম্যাচে তাদের চেয়ে ১৫ পয়েন্ট পিছিয়ে থাকা রিয়ালের ঠিকানা তালিকার তিন নাম্বার। দুই চিরশত্রুর মাঝে আছে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। তাদের ঝুলিতে জমা পড়েছে ৭৫ পয়েন্ট। অ্যাটলেটিকো আবার এই রাউন্ডের ম্যাচে এস্পানিয়লের কাছে ২-০ গোলে হেরে গেছে।