জীবন বাঁচানোই জীবন যাদের
- Details
- by সাইফ হাসনাত, কক্সবাজার থেকে
নবদম্পতি হানিমুনে এসেছেন কক্সবাজার। অবশ্যগন্তব্য সমুদ্র সৈকতেও চলে এসেছেন হাত ধরাধরি করে। তারপর পা ভেজাতে নেমে পড়েছেন সমুদ্রের কোলে। এরপর যা হলো, তা হয়তো দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি তারা। ঢেউয়ের নাচ তাদের এতোটাই সম্মোহিত করে ফেললো যে, তারা ঢুকে পড়লেন ঢেউয়ের নিচে। অথচ সাঁতার জানেন না একজনও! কয়েক মুহূর্ত পর দেখা গেলো একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরতে ধরতে তারা গেলেন ডুবে। দূরের ওয়াচ টাওয়ার থেকে তাদের দেখে দৌড়ে গেলেন কামাল। কয়েক মিনিটের দমবন্ধ উত্তেজনা শেষে নবযুগলকে উদ্ধার করে নিয়ে এলেন স্থলে।
আরেক দিনের ঘটনা। ছয় জনের একটি পরিবার বড় এক ঢেউয়ের বেগ সামলাতে না পেরে ডুবে যাচ্ছিলো সাগরের পানিতে। সেখানে ছিলো শিশু ও নারীও। ঘটনাটি দেখে ফেলেন কামাল। দৌড়ে যান নিজের দল নিয়ে। আবারও নিজেদের জীবন বাজি রেখে পরিবারের সব সদস্যকে অক্ষত অবস্থায় নিয়ে আসেন স্থলে। অন্যদের তুলনায় বেশি গভীরে ডুবে যাওয়ায় এ সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন একজন। তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে কামালরা ভর্তি করে দেন হাসপাতালে।
এভাবে আরো বহু মানুষের জীবন বাঁচানোর অভিজ্ঞতা আছে কামালের। শুধু কামালের নয় অবশ্য। তার মতো বেশ কয়েকজন যুবক বুকটান করে দাঁড়িয়ে আছেন বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত— কক্সবাজারে। দেশ-বিদেশ থেকে আসা পর্যটকদের দৃষ্টিতে তারা একেবারেই নগণ্য হয়তো, কিন্তু যখনই জীবন হারানোর মতো বিপদের ভয়, তখনই হাজির হন তারা। জীবন বাঁচানোই যে তাদের কাছে আসল জীবন!
কামালের বয়স বড় জোর ২০ বা ২২ হবে। এই বয়সে ক্যারিয়ার নিয়ে, জীবন নিয়ে বিস্তর ভাবনা থাকার কথা তার। কিভাবে বড় চাকরি পাওয়া যায়, কিভাবে আরো বেশি অর্থ কামানো যায়, তার ডুবে থাকার কথা সেই সব চিন্তায়। কিন্তু কক্সবাজারের সৈকতে পড়ে থাকা কামালের চিন্তা তা নিয়ে নয়। সাগরের সন্তান হয়ে উঠা কামালের নেশা ও পেশা ওই সাগরই। বিস্তৃত জলরাশিতেই জীবন খুঁজে নিয়েছেন তিনি। ভালোবেসে বুকে জড়িয়েছেন সাগরকেই। এভাবেই চলছে তার জীবন বাঁচানোর অসাধারণ জীবন!
সি-সেইফ নামের একটি অলাভজনক সংস্থার লাইফগার্ড হিসেবে কাজ করেন কামাল। এই সংস্থায় তার সঙ্গে আছেন আরো ৩০ জন যুবক। কামাল শোনালেন তার অন্য জীবনের গল্প, ‘কয়েক বছর স্বেচ্ছাসেবক থাকার পর এখন আমি বেতনভুক্ত হয়েছি। আসলে সাগর আমার ভালোবাসা আর লাইফগার্ডের কাজ আমার কাছে নেশার মতো।’
কামালের সাগরপ্রেম আবশ্য অনেক আগের ব্যাপার। সার্ফার হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন থেকেই সাগরের সাথে কামালের সখ্য। স্বপ্নটা পূরণই করে ফেলেছেন তিনি। গত পাঁচ বছর ধরে জাতীয় সার্ফিং প্রতিযোগিতার শিরোপা উঠেছে তার হাতেই। তবে সার্ফিং নয়, কামালের বেশি পছন্দ লাইফগার্ডের কাজ।
কামাল বলেন, ‘মানুষের জীবন বাঁচানোর অনুভূতি যে কেমন, আমি তা বলে বোঝাতে পারবো না। আমি এই কাজ করে যেতে চাই। এ ছাড়া ভবিষ্যতে সার্ফিংয়ে অলিম্পিকে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে চাই। আশা করি সেই সুযোগ পাবো।’
কামালদের সি-সেইফ সংস্থার লাইফগার্ডদের প্রশিক্ষণ সহায়তা দেয় ব্রিটিশ সংস্থা রয়্যাল ন্যাশনাল লাইফবোট ইন্সটিটিউট (আরএনএলআই)। তাদের অর্থ দিয়ে সহায়তা করে বাংলাদেশি সংস্থা সেন্টার পর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)।
জীবন বাঁচানোর অবিশ্বাস্য আনন্দের এই কাজে যোগ দিতে পারেন যে কেউ। তবে তার জন্য কয়েক বছর থাকতে হয় স্বেচ্ছাসেবক। লাইফগার্ডের দায়িত্বে যে গভীর আত্মনিয়োগের প্রয়োজন, তার শিক্ষা হয়ে যায় ওই স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালনের সময়ই।
উন্নত বিশ্বের লাইফগার্ডদের কাজের জন্য থাকে আধুনিক সব সরঞ্জাম। কিন্তু বাংলাদেশে সে সব নেই। কামালের গ্রুপ প্রধান উসমানের কণ্ঠে তাই ফুটে উঠলো আক্ষেপ, ‘আমরা যে সংস্থার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছি, তাদের লাইফগার্ডদের ওয়াটার বাইক, বিচ বাইক আছে। এমন কি আছে হেলিকপ্টার ও জাহাজও। আমাদের সে সব নেই। ফলে কখনো কখনো প্রয়োজনীয় কাজ করতে সমস্যা হয়। তারপরও যা আছে, তা নিয়ে আমরা কাজ চালিয়ে নিচ্ছি। সব ঠিকঠাকই চলছে। আশা করছি অদূর ভবিষ্যতে আমাদের আধুনিক সরঞ্জাম থাকবে।’
পানিতে ডুবে গিয়ে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে সাধারণ চিকিৎসা দেয়ার শিক্ষা আছে কামাল-উসমানদের। কমাল এ বিষয়ে বললেন, ‘প্রয়োজন পড়লে আমরাই প্রাথমিক চিকিৎসা দেই। ডুবে যাওয়ার পরও যদি কারো জ্ঞান থাকে, তাহলে তাকে আমরা রিকভারি পজিশনে দেই। যদি কেউ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে এবং শ্বাস জারি থাকে, তাহলে তাকে সিপিআর (কার্ডিওপালমোনারি রেসুস্কিটেশন, বুকে চাপ দেয়া) দেই। আর যাদের জ্ঞানও থাকে না, শ্বাসও বন্ধ হয়ে যায়— অর্থাৎ যাদের হার্ট ব্লক হয়ে যায়, তাদেরকে আমরা পাম্পিং করে হার্ট স্বাভাবিক করার চেষ্টা করি। পরিস্থিতি আরো গুরুতর হলে নিয়ে যাই হাসপাতালে।’
মানুষের জীবন বাঁচানোর কাজ করতে গিয়ে জীবনের দর্শনই বদলে গেছে কামালদের। তাদের কথাবার্তা, চলন-বলন হয়ে গেছে অন্যদের চেয়ে আলাদা। সামান্য বিপদ দেখলেই সাধারণ একজন মানুষের চোখে-মুখে নেমে আসে রাজ্যের অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারই কামালদের চোখ-মুখে ছড়িয়ে আনন্দের আভা— আরো একজন মানুষকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারার সম্ভাব্য আনন্দে মুখর হয়ে ওঠেন তারা। জীবন বাঁচানোর জীবন যাদের, তারা বোধহয় এমনই হন!
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.