অন্যের স্মৃতি ধরতে গিয়ে তারা নিজেরাই হয়ে যাচ্ছেন স্মৃতি
- Details
- by সাইফ হাসনাত, কক্সবাজার থেকে
হঠাৎ মেঘ করলো কক্সবাজারের আকাশে। সৈকতে দাঁড়িয়ে ঢেউয়ের গর্জন শুনতে শুনতে যে অবিশ্বাস্য রকমের দারুণ সময় কাটছিলো, তাতে বাধ সাধলো প্রকৃতি। প্রকৃতি কিভাবে তার নিজের এক সৌন্দর্য আড়াল করে দেয় অন্য সৌন্দর্যের ঝলকানিতে; ভাবনায় যখন এই দর্শনের আনাগোনা, তখনই পাশে এসে দাঁড়ালেন মধ্য বয়স্ক এক ব্যক্তি। কয়লাকালো গায়ের রঙ। চোখে-মুখে অদ্ভুত মায়ার সঙ্গে মিশে আছে ক্লান্তি আর অচেনা অনিশ্চয়তা।
বললেন, ভাই ছবি তুলবেন? পাঁচ টাকা প্রতি পিস। মেমোরি কার্ডে দিয়ে দিবো। আপনার মোবাইলেও নিতে পারবেন। চাইলে প্রিন্ট করেও দিতে পারবো। তিনি বলে যাচ্ছিলেন আর আমি দেখছিলাম তার বেশভূষা। গায়ে লাল পোলো শার্ট। পুরোনো হয়ে গেছে অনেক দিন আগে।
না, আমি ছবি তুলবো না। সঙ্গের ফোন দেখালাম তাকে। বোঝালাম, আজকাল ছবিটবি সব এ দিয়েই তোলা হয়ে যায়। তিনি কাঁধে ঝুলতে থাকা ডিএসএলআর নিয়ে অন্য দিকে হাঁটা দিলেন। তার সঙ্গে হাঁটা দিলো আমার মনোযোগও। পিছন থেকে ডেকে উঠলাম।
আপনার নাম কী? তার সরল উত্তর। বাবু। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে ১৮ বছর ধরে ভ্রাম্যমাণ ফটোগ্রাফারের কাজ করছেন। ‘ভ্রাম্যমাণ’ শব্দটার মধ্যে যে গভীর অনিশ্চয়তা আছে, তার প্রামাণ্যচিত্র হয়ে উঠেছেন বাবু। ১৮ বছরে নিজের পেশা বদলাতে পারেননি তিনি। সব অনিশ্চয়তাকে মেনে নিয়ে গলায় ঝুলিয়ে চলছেন ক্যামেরা। সব পেশায় দিনে দিনে উন্নতির পথ খুলে গেলেও, তার পথ হয়ে গেছে সংকীর্ণ।
১৮ বছর আগে সৈকতে ঘুরতে আসা পর্যটকের স্মৃতিময় সময় ধরে দেয়ার কৌতুহল নিয়ে হাতে তুলে নিয়েছিলেন ক্যামেরা। প্রায় দুই দশক ধরে এই কাজ করতে করতে বাবু খেয়াল করেছেন যে, অন্যের স্মৃতি ধরে দিতে গিয়ে তিনি নিজেই ঢুকে যাচ্ছেন স্মৃতির পাতায়। গুরুত্বপূর্ণ থাকছেন বটে, কিন্তু মূল্যটা হয়ে যাচ্ছে নাই।
বাবুর কাছ থেকে ছবি তোলার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়া প্রথম পর্যটক আমি নই। বাবুও সৈকতে দাঁড়িয়ে ভ্রাম্যমাণ ফটোগ্রাফারের মতো অনিশ্চিত পেশার একমাত্র লোক নন, বরং তার মতো কয়েকশ ফটোগ্রাফার সৈকতে দাঁড়িয়ে থাকেন। পর্যটকদের কাছে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলে কিছু টাকা কামানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদের চেষ্টাটা আর আগের মতো সফল হয় না।
বাবু শোনালেন গল্প, ‘সৈকতে বেড়াতে আসা মানুষ এখানকার সময়ের ছবি তুলে রাখতে চায়। সেই ভাবনা থেকেই ১৮ বছর আগে ক্যামেরা ভাড়া করে কাজ শুরু করি। পরে নিজের ক্যামেরা হয়েছে। এই কাজ থেকে ভালো টাকাও কামিয়েছি। কিন্তু এখন আর হচ্ছে না। সবার কাছে ডিজিটাল ক্যামেরা আছে, স্মার্টফোন আছে। লোকজনের আর ফটোগ্রাফার লাগে না।’
কথাগুলো বলতে বলতে বাবু কেমন বিষণ্ন হয়ে ওঠেন। আবার বলতে শুরু করেন, ‘এখানে পাঁচ-ছয়টা ল্যাবও ছিলো। ছবি তুলে প্রিন্ট দিতাম সেখানে। ব্যবসা ভালো নয় বলে সেগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে। একটা-দুইটা কোনোমতে টিকে আছে অবশ্য। তবে যে কোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে।’
ল্যাব বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে বাবুর ফটোগ্রাফার জীবনের মোটামুটি সমাপ্তিও। বাবুর মতো ক্যামেরা নিয়ে ঘোরা আরো শত শত ফটোগ্রাফারের অবস্থাও হবে এমনই। এই বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে আরো বিষণ্ন হয়ে পড়েন বাবু। বলতে শুরু করেন, ‘কাজটা ছেড়ে দিবো ভাবছি। বিদেশে চলে যাওয়ার চিন্তা করছি। লোকজনকে ধরে একটা কাজ জুটিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি। দেখা যাক কী হয়। এভাবে তো আর চলা যায় না।’
৪০ বছর বয়স হয়ে যাওয়া বাবু ১৮ বছর ধরে টিপে যাচ্ছেন ক্যামেরার বাটন। মানে অন্য কোনো কাজ তিনি পারেনই না। তাহলে বিদেশ গিয়ে করবেন কী? প্রশ্নটা শুনে হাসেন বাবু। সেই হাসিতে যে বেদনার বালুচর জেগে ওঠে, তা মনে হয় লিখে প্রকাশ করা যায় না। সঙ্গে বাবু বলেন, ‘জানি না কী করবো। কিন্তু কিছু একটা তো করবোই।’
১৮ বছর আগে একটা ছবি তুলে প্রিন্ট করে ক্রেতার হাতে তুলে দিতে ২০ টাকা করে নিতেন এই ফটোগ্রাফার। এখনও তাই নেন। তবে এখন দেন অন্য সেবাও। শুধু ছবি তুলে দিয়ে দেন ক্রেতার মোবাইলে বা মেমোরি কার্ডে। এতে নেন পাঁচ টাকা করে। এই সেবাও এখন বন্ধের মুখে। এরা তাহলে চলেন কী করে?
বাবু জানালেন, একেবারে গ্রাম থেকে যদি কোনো পর্যটক আসেন, যাদের কাছে ডিজিটাল ক্যামেরা বা স্মার্টফোন পৌঁছেনি, তাহলেই কেবল একটা দুইটা কাজ তারা পেয়ে যান। কিন্তু এই রকম সুযোগ আসে খুব কম। এক রকম নিরুপায় হয়েই তাই ৪০ পেরিয়ে আসা বাবুকে অন্য পথের সন্ধান করতে হয়। যে পথ হয়তো তার জন্য অপেক্ষা করছে জীবনের কঠিনতম সময় নিয়ে।
অন্যের স্মৃতি ধরে রাখতে গিয়ে, সময় এখন বাবুদের উপহার দিচ্ছে স্মৃতি হয়ে যাওয়ার মুহূর্ত। এ জন্য বাবুর আক্ষেপ হয়। কিন্তু রাগ হয় না। কার উপর রাগ করবেন তিনি! জীবন যে এমনই, কখন কাকে কোন বাঁকে বসিয়ে দেয় বা দাঁড় করিয়ে রাখে, তা কেউ জানে না। বাবুও তাই জানতে পারেন না, প্রায় বিলুপ্তির মুখে পড়া তার ফটোগ্রাফার সত্তা কিভাবে নতুন করে জেগে উঠবে, কিভাবে তার জীবনটা আবার ভালো লাগার কাজের ভিতরে ডুব দিয়ে হয়ে উঠবে প্রাণবন্ত।
বাবু যখন তার জীবনের গল্প বলে অন্য দিকে হাঁটা দিলেন, কক্সবাজারের আকাশের মেঘেরা তখন আর নিজেদের ভার সইতে না পেরে বৃষ্টি হয়ে ঝরতে শুরু করলো। বাবু তাতে বিরক্ত হলেন হয়তো। কারণ তাকে তো তার নিজের জীবনের ভারটা ঠিকই বইতে হবে। মানুষ তো আর ভার সহ্য করতে না পেরে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে পারে না!
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.