মরুভূমির অগ্নিতপ্ত জীবন থেকে ক্রিকেটের সবুজ ময়দানে সাকিল

সালাহুদ্দিন সাকিলের জীবনটা ছিলো এক অভিশপ্ত জীবনের মতো। তীব্র খরার মৌসুমেও উপমহাদেশের তাপমাত্রা ৪০-এর ঘরে যায় না। কিন্তু উপমহাদেশের জলহাওয়ায় বড় হওয়া সাকিলকে বছরের পর বছর কাজ করতে হয়েছে ৫০ ডিগ্রি সেলিয়াসের বেশি তাপমাত্রার মরুভূমিতে। আরব আমিরাতের মরভূমিতে তার জীবন ছিলো অগ্নিতপ্ত। সেই জীবন পিছনে ফেলে এসেছে সাকিল এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ক্রিকেটের সবুজ ময়দান।

সাকিল সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘আবু ধাবিতে ভোর চারটায় কাজে চলে যেতে হতো। সেখানে পলিথিন ব্যাগে ভরে ভাত নিয়ে যেতাম। মরুভূমির বাতাসের কারণে থালায় ভাত খাওয়ার সুযোগ নেই। কখনো কখনো তাপমাত্র ৫০-এর ঘর ছুঁতো। তরকারি নষ্ট হয়ে যেতো। সেখানে জীবন এমনই কষ্টকর ছিলো।’

ওই রকম জীবনের পর দশ বছরও হয়নি, সাকিলের জীবন আমূল বদলে গেছে। মরুভূমির অগ্নিতপ্ত জীবন থেকে এখন ক্রিকেটের সবুজ ময়দানে সাকিল। গত সপ্তাহেই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছে তার।

মরভূমির শ্রমিক সাকিল এখন বাংলাদেশের বাঁহাতি পেসার। বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগের (বিসিএল) গত রাউন্ডে তিনি খেলেছেন ওয়ালটন সেন্ট্রাল জোনে। যেখানে তিনি অধিনায়ক হিসেবে পেয়েছেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে। ওই ম্যাচে মাহমুদুল্লাহ আবু হায়দার রনির সঙ্গে সাকিলকে দিয়ে বোলিং শুরু করেন। সাকিল ওই ম্যাচে দুটি উইকেট নেন। এর মধ্যে একটি ছিলো জাতীয় তারকা ইমরুল কায়েসের।

সাকিল বলেন, ‘রিয়াদ ভাইকে আমি কেবল টিভিতেই দেখেছি। এখন তার অধিনায়কত্বে খেলছি। তিনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন। আমার জন্য এই ঘটনা অবিশ্বাস্য।’

২৮ বছর বয়সী সাকিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের গুরুত্বপূর্ণ কয়েক ব্যক্তির নজরে পড়ে গেছেন এরই মধ্যে। সবার আগে তিনি নজর কাড়েন মিজানুর রহমানের। গত প্রিমিয়ার লিগে প্রাইম দোলেশ্বরে কোচ ছিলেন তিনি। মিজানুরের অধীনেই লিস্ট-এ অভিষেক হয় সাকিলের।

পরে মিজানুরই এই বাঁহাতি পেসারকে বিসিএল দল ওয়ালটন সেন্ট্রাল জোনে সুযোগ পাইয়ে দেন। মিজানুর সাকিলকে প্রথম দেখেন প্রাইম দোলেশ্বরের নেট সেশনে। পরে ওই দলের হয়েই পাঁচটি লিস্ট-এ খেলেন সাকিল। এর চেয়েও বড় ঘটনা হলো তার প্রথম শ্রেণির অভিষেক।

মাঠ মাতানো শুরু করলেও সাকিলের মন থেকে মরুভূমির অভিজ্ঞতা মুছে যায়নি। তিনি বলেন, ‘আমি ওয়েল্ডিংয়ের কাজ জানতাম। কিন্তু আমাকে পাঠানো হয় মরুভূমিতে। সেখানে স্টিলের কাঠামো তৈরির কাজ করতাম। ওই সময়ে আল্লাহর কাছে বলতাম, কবে ওই জীবন থেকে মুক্তি পাবো। ২০০৬ সালে আমার বন্ধুরা যখন এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে, আমাকে তখন ভাগ্যের সন্ধানে যেতে হয় বিদেশ। আমার মন চায়নি, কিন্তু পরিবারের দরকারে আমাকে সেখানে যেতেই হয়।’

ঢাকার ৪০ কিলো দক্ষিণের শহর মুন্সিগঞ্জে বেড়ে উঠেন সাকিল। সেখানে তার শৈশব-কৈশর কেটেছে টেপ টেনিস খেলে। কিন্তু আরব আমিরাত যাওয়ার পর তার ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নটা পড়ে যায় ঝুঁকির মুখে। চার বছর পর যখন তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়, তখন একটা ছুটি পান তিনি। ওই ছুটিই বদলে দেয় সাকিলের জীবন।

২০১২ সালের দিকে আবার টেপ-টেনিস নিয়ে মেতে উঠেন সাকিল। খেলতে থাকেন আবার। ওই সময় নারায়ণগঞ্জে একটি ক্লাব চালাতেন কোচ গোলাম রাসুল। সেখানে তার কোচিং নিতে শুরু করেন সাকিল। দুই বছর পর থার্ড ডিভিশন, সেকেন্ড ডিভিশন ও হয়ে ফার্স্ট ডিভিশন খেলার সুযোগ আসে সাকিলের সামনে।

সাকিল বলেন, ‘২০১৪ সালে আমি যখন ক্লাবে ট্রায়াল দিতে যাই, সবাই আমাকে দেখে দেখে হাসছিলো। কারণ আমার কিছুই ছিলো না। আমার বন্ধু মেহরাব হোসেন জোসি আমাকে এক জোড়া জুতা ও ব্যাট দেয় এবং সে-ই ক্লাবে আমার একটা ট্রায়ালের ব্যবস্থা করে। সৌভাগ্যবসত ক্লাব রাজি হয় এবং আমি সেখানে নজর কাড়ার মতো পারফর্ম করি।’

ডিভিশনাল পর্যায়ে খেলার পর এ বছর লিস্ট-এ খেলেন সাকিল। এর পিছনে যার হাত, সেই মিজানুর রহমান তার বিষয়ে বলেন, ‘সাকিল আমাদের নেটে আসে নেট বোলার হিসেবে। তার শারীরিক গঠন ও পেস আমার পছন্দ হয়ে যায়। সে এখনো নিখুঁত বোলার নয়। তবে আমার বিশ্বাস সে নিখুঁত হয়ে উঠবে। সে বাংলাদেশের ভবিষ্যতও হতে পারে।’

মিজানুরের অনুরোধে সাকিলকে দলে নেয় সেন্ট্রাল জোন। দলটির ম্যানেজার মিলটন আহমেদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা নেট বোলার হিসেবে সাকিলকে রাজশাহীতে নিয়ে আসি। নেটে সে ছিলো অসাধারণ। তার ইনসুইং ও গতির কারণে আমরা তাকে একটা সুযোগ করে দেই এবং তার অভিষেক হয়ে যায়।’

রাজশাহীতে সাকিলের খেলা দেখে অভিভূত নির্বাচক হাবিবুল বাশার সুমনও। দিনে ১৪-১৫ ঘণ্টা করে কাজ করা একজন মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকের জন্য এর চেয়ে প্রাপ্তি আর কী হতে পারে? কে জানে, হয়তো আরো বড় প্রাপ্তিই অপেক্ষা করছে জীবনের কঠিন কঠিন সত্য পেরিয়ে ক্রিকেট ময়দান দাপিয়ে বেড়ানো সাকিলের সামনে! ইএসপিএন ক্রিকইনফো অবলম্বনে।