এই মাশরাফি অবিশ্বাস্য, এই মাশরাফি বিস্ময়কর

আর কতো বিস্ময় তিনি লুকিয়ে রেখেছেন তার মহাবিস্ময়ের ভাণ্ডারে? এক সময় এই প্রশ্নটার শেষে বসতে পারতো আশ্চর্যবোধক চিহ্ন। বাক্যটাও হতে পারতো কেবলই বিস্ময়সূচক। কিন্তু এখন এটি একটি সিরিয়াস প্রশ্ন!

বয়সের বসন্ত পেরিয়ে গেছে ৩৪টি। এই সময়ে এসে একজন পেসার আর যাই করুন না কেনো, মাশরাফির মতো প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে এমন দাপুটে হয়ে হাজির হওয়ার স্বপ্ন নিশ্চয় দেখবেন না। মাশরাফিকে স্বপ্ন দেখতে হচ্ছে না। স্বপ্নেরাই বরং তার আবেশে ডুবে থাকছে! তিনিই বাস্তবের জমিনে নামিয়ে দেখাচ্ছেন একটা পর একটা স্বপ্নের ঘোর লাগা মুহূর্ত।

চলতি ওয়ালটন ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে নিজের অষ্টম ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেছেন মাশরাফি। এই কথা দিয়ে অবশ্য তার হ্যাটট্রিকের মহিমা পুরোপুরি প্রকাশ করা যাচ্ছে না। মাশরাফি আসলে করেছেন ডাবল হ্যাটট্রিক।

আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না থাকলেও চার বলে চার উইকেট নেয়াকে তো ডাবল হ্যাটট্রিকই বলা হয়। অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলে এটি স্বীকৃতই অবশ্য। কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় ডাবল হ্যাটট্রিক বলে কিছু নেই। ওই সামগ্রিক বিবেচনার ধার অবশ্য ধারার প্রয়োজন নেই মাশরাফি-ভক্তদের। তারা আপাতত নায়কের ডাবল হ্যাটট্রিকের আনন্দেই বিভোর!

ফতুল্লায় মাশরাফিদের দল আবাহনী লিগে তাদের অষ্টম ম্যাচে মুখোমুখি হয় অগ্রণী ব্যাংকের। প্রথম ইনিংসে ব্যাটিং করে মাশরাফিরা পান ২৯০ রানের পুঁজি। ১৩৩ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলেন নাজমুল হোসেন শান্ত। এরপর জবাব দিতে নেমে অগ্রণী ব্যাংকের হয়ে সেঞ্চুরি করেন আগের ম্যাচে এক রানের জন্য সেঞ্চুরি মিসের কষ্টে পোড়া শাহরিয়ার নাফীস। তার ব্যাটে চড়ে আবাহনীকে হারানোর স্বপ্নের সাহস পেয়ে যায় অগ্রণী ব্যাংক। এভাবেই এগুতে থাকে ম্যাচ।

শেষ ওভারে গিয়ে অগ্রণী ব্যাংকের প্রয়োজন দাঁড়ায় ১৩ রান। বল হাতে আসেন মাশরাফি। তখনও তাদের অক্ষত আছে চার উইকেট। তার আগের দুই ওভারে ২০ রান নেয়া অগ্রণী ব্যাংক নিশ্চিত জয়ের অপেক্ষায়ই ছিলো।

এরপরই বিস্ময়-ভাণ্ডারের আরো একটা কপাট খুলে দেন মাশরাফি। প্রথম বলে এক রানের বেশি নিতে পারেননি আব্দুর রাজ্জাক। স্ট্রাইক পান ধীমান ঘোষ এবং তুলে দেন ক্যাচ। বদলি ফিল্ডার জয়রাজ শেখ ক্যাচটা নিতে একদমই ভুল করেননি। জয়রাজ ক্যাচটা নিতে নিতেই প্রান্ত বদলে স্ট্রাইকে চলে যান রাজ্জাক এবং পরের বলে তিনি ক্যাচ তুলে দেন নাজমুল হোসেন শান্তর হাতে।

এই পরিস্থিতিতে আবাহনী হারের ভয়টা কাটিয়ে ওঠে। কারণ শেষ তিন বলে তখন অগ্রণী ব্যাংকের প্রয়োজন ১২ রান। মাশরাফির হয়তো আগের সেই তেজ নেই, আগের জোরও সময়ের পরিক্রমায় কমে গেছে; তারপরও শেষ তিন বলে ১২ রান খরচ করে ফেলার মতো দুর্বল তিনি হননি।

হ্যাটট্রিকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মাশরাফিকে মোকাবেলা করতে আসেন শফিউল ইসলাম। ব্যাট হাতে যিনি অন্য দশজন বোলারের মতো আড়ষ্ট হন না। ২০১১ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচজয়ী এক ইনিংস খেলার কীর্তি আছে তার। সুতরাং হ্যাটট্রিকের স্বপ্নটা হয়তো মাশরাফির কাছেই ফিকে মনে হচ্ছিলো।

কিন্তু বিস্ময়ের মালিকও তো কখনো কখনো নিজের বিস্ময়কর ক্ষমতা সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকতে পারেন, শফিউলকে সাইফ হাসানের ক্যাচ বানিয়ে কি সেটাই মনে হয়নি মাশরাফির? শফিউলকে ফিরিয়ে যে কোনো ধরনের ক্রিকেটে প্রথম হ্যাটট্রিকের মালিক বনে যান মাশরাফি। আবাহনীর ততক্ষণে ম্যাচ হারের আর কোনো শঙ্কাই নেই। ওভারের পঞ্চম বলটা তাই স্রেফ করে দিয়েছিলেন মাশরাফি এবং তাতেই উইকেটের পিছনে ক্যাচ দিয়ে দেন ফজলে রাব্বি। মোহাম্মদ মিঠুনের বিশ্বস্ত গ্লাভস কি সেই অমূল্য ক্যাচ ফেলতে পারে! চার বলে চার উইকেটের অবিস্মরণীয় কীর্তিটা লেখা হয়ে যায় তাতেই।

এই মাশরাফি যে বিস্ময়কর, তার প্রমাণই কি এই চার বলে চার উইকেট-কীর্তি? নাহ, মোটেই তা নয়। এটা বরং তার বিস্ময়ের একটা কণা মাত্র। ঢাকা লিগে আট ম্যাচে ২৫ উইকেট নিয়ে ফেলেছেন এবার। এর মধ্যে দুইবার পাঁচ বা এর চেয় বেশি উইকেট। দুইবার চারটি করে। মাশরাফি যেনো মাঠেই নামছেন বিস্ময় ছড়াতে আর তার অবিশ্বাস্য সত্তার পরিচয় তুলে ধরতে!

মাশরাফির এমন কীর্তির আলাপ পারতে গেলে যে আনন্দের রেণু ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে, সমান্তরালে তা ডুবে যায় বেদনার চোরাবালিও। দুই হাঁটুতে সাত অস্ত্রোপচারের সেই আক্ষেপ ভোলার যে কোনো উপায়ও নেই। যদি ওই সব যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে তাকে না যেতে হতো, কতো কী যে হতে পারতো।

কে জানে, তখন হয়তো অবিশ্বাস্য বা বিস্ময়কর শব্দ দুটি তাকে প্রকাশই করতে পারতো না! পারতো কি? এটাও কিন্তু একটি সিরিয়াস প্রশ্ন!