ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামে শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন প্রতীকী স্থাপনা ও ভাস্কর্য। এসব স্থাপনা ও ভাস্কর্যের হালচিত্র নিয়ে ধারাবাহিক বিশেষ প্রতিবেদনের আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব। লিখেছেন- এম.এস.আই খান।

বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের ইতিহাসকে ধারণ করে নির্মিত অন্যতম বৃহৎ ভাস্কর্যের নাম স্বাধীনতা সংগ্রাম। শামীম শিকদার এই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেছেন। ১৯৯৯ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটির উদ্বোধন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফুলার রোডে সলিমুল্লাহ হল, জগন্নাথ হল ও বুয়েট সংলগ্ন সড়ক দ্বীপে (উদয়ন স্কুলের সামনে) এই ভাস্কর্যটির অবস্থান।

এখানে শুধু দেশ নয় দেশের বাইরের অসংখ্য জ্ঞানীগুনি মানুষের ভাস্কর্য স্থান পেয়েছে। তবে এই ভাস্কর্যগুলোর মান নিয়ে ভাস্করবোদ্ধারা বড় ধরনের আপত্তি তুলেছেন। ভাস্কর্যে সবার উপরে স্থান দেয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। কিন্তু ভাষণরত বঙ্গবন্ধুকে ফুটিয়ে তুলতে যেয়ে তার বাম হাত ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর বাম হাতের তর্জনী ও নূর হোসের প্রতিকৃতি! ছবি: রাশেদুল ইসলাম

৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু অধিকাংশ সময়ে ডান হাত দিয়ে নির্দেশ দিয়েছেন বলেই বিশ্লেষকরা মত দিয়েছেন। ফলে সাত মার্চের ভাষণরত অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর চিত্র ফুটিয়ে তুলতে ভাস্কর ‘বঙ্গবন্ধুর বাম হাত’ উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে তাকে অবেহলা করেছেন বলেই মনে করেন অনেকে।

অন্যদিকে শহীদ নূর হোসেনর যে ভাস্কর্যটি সেখানে দাঁড় করানো হয়েছে তা অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে তৈরি করা হয়েছে বলেই অনেক দর্শনার্থী অভিযোগ করেছেন। আরেকটু যত্নশীল হলে ভাস্কর্যগুলো আরো সুন্দর হতে পারত বলে মনে করেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী আরমান শাহরিয়ার বলেন, এই ভাস্কর্য চত্ত্বরটি দূর থেকে দেখতে বেশ ভাল লাগে। ভিতরে প্রবেশ করলেও আমরা যেন এক মঞ্চে বিশ্ববিখ্যাত অনেক চরিত্রকে দেখতে পাই। কিন্তু খারাপ লাগে তখন যখন ভাস্কর্যগুলোর দিকে তাকালে ভাস্কর্যগুলোর চেহারা ও গড়নে ভিন্নরূপ দেখতে পাই। বঙ্গবন্ধুর বাম হাতের তর্জনী, মুখায়ব, নূর হোসেনসহ বেশ কিছু প্রতিকৃতি দেখতে অনেকটা বিকৃত লাগে।’

‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ লেখা না থাকলে বোঝা কষ্ট কর এটি নূর হোসেনের প্রতিকৃতি!

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগের অধ্যাপক মো. এনামুল হক বলেন, ‘ওখানে যে ভাস্কর্যগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে তা সংস্কার করা উচিত। কেননা ওই কাজগুলো একেবারেই মানহীন জঞ্জালের মত করে তৈরি করা হয়েছে। যে কোন মানুষ যার স্বাভাবিক বিচারক্ষমতা রয়েছে তিনিও এগুলো দেখে রুষ্ট হবেন। দেশের বাইরে থেকে যারা আমাদের এখানে এসে এ কাজগুলো দেখবেন, তারা ভাববেন এ দেশের ভাস্করদের দক্ষতা তাহলে এই!’

‘যদি বহু বছর পূর্বের কোন ভাস্কর্য যেমন গ্রিক সভ্যতার, রোম সভ্যতার ভাস্কর্য এর পাশে রাখা হয় তবে মানুষভাববে এগুলো (স্বাধীনতা সংগ্রাম চত্ত্বরে উপস্থাপিত) প্রাচীন আর গ্রীক, রোমের ভাস্কর্যগুলো আধুনিক ভাস্কর্য! মানের দিক থেকে এতটাই বাজে হয়েছে যে, তুলনা করলে মনে হবে এগুলো কোন প্রাগৈতিহাসিক যুগের! বেশ কয়েকবার এগুলো সংস্কারের জন্য আলোচনা হলেও কার্যকর হয়নি। দ্রুত এগুলো সংস্কার করা প্রয়োজন বলেও মত দেন অধ্যাপক এনামুল হক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্য চত্ত্বরকে ‘একটি জঙ্গল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্য চত্ত্বরকে এক কথায় বলা যায় একটি জঙ্গল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত জায়গায় এমন নিম্নমানের কাজ উপস্থাপন করা একেবারেই অনুচিত। যতদ্রুত সম্ভব একটি কমিটি করে দিয়ে ওই ভাস্কর্যগুলোকে পুনস্থাপন করা ‍উচিত। কেননা প্রতিদিন অনেক মানুষ এই ক্যাম্পাসে ঘুরতে আসেন। তাদের মধ্যে যারা একটু মনোযোগী তারা এ ধরনের বাজে কাজ দেখে হতাশ হবেন এবং আমাদের শিল্পীমান নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন।’

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বেশির ভাগ সময়ই ডান হাত দিয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। সেহেতু ৭ মার্চের ভাষণচিত্রকে তুলে ধরতে ডান হাত উপস্থাপন করা উচিত। ফলে স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্যটিতে যে ধরণের ভুল রয়েছে তা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। আমরা শিগগিরই এ বিষয়ে একটি নোটিশ দেব এবং ভাস্কর্যটির বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেব।’

উৎসব এলেই স্মরণ, ভাস্কর্য আছে কিন্তু নাম জানে না কেউ! (প্রথম পর্ব)

শহীদ মিনার পূর্ণতা পায়নি ৬৬ বছরেও! (দ্বিতীয় পর্ব)