নাসার বিজ্ঞানী থেকে পথের ভিখারি!
- Details
- by সাইফ বিন আইয়ুব
কাগজে-কলমে গ্রামের নাম বসন্তপুর। তবে ভারতের বিহারের ভোজপুর জেলার মানুষের কাছে গ্রামটি ‘ভাশিষ্ঠা বাবুর গ্রাম’ নামেই পরিচিত। এই গ্রামেরই অপ্রশস্ত পথ ধরে সামনে এগিয়ে গেলে এক সময় ভাঙ্গা কংক্রিটের পুরনো এক তলা একটি বাড়ি চোখে পড়ে। বাড়ির গায়ে খসে পড়া পলেস্তারার পাশাপাশি গোবরের প্রলেপ দেয়া। গ্রামে বিদ্যুতের বালাই নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে তুখোড় রাজনৈতিক নেতাদের পা পড়ে এই বাড়িতে। তখন অবশ্য নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ মেলে এই ভাঙ্গা বাড়িতেও।
জানালাবিহীন প্রায় ‘পড় পড়’ এই বাড়ির সন্তান ভাশিষ্ঠা নারায়ন সিং। জন্ম ১৯৪২ সালে। সে হিসেবে তাকে বৃদ্ধই বলা চলে। বাড়ির ভিতরেই মাটিতে বিছানো একটি কাঁথায় শুয়ে আছেন তিনি। চোখে ঘোলাটে দৃষ্টি। ঘরের দেয়ালে অযত্নে অবহেলায় একটি বাঁধানো সার্টিফিকেট ঝুলছে। বৃদ্ধ ভাশিষ্ঠা তো বটেই, বাড়ির অন্য কারও সময় নেই ওটার দিকে নজর দেয়ার।
ভাশিষ্ঠাকে ভারতের কিংবদন্তি গণিতবিদ বলে মনে করা হয়। তবে তার জীবন ইতিহাস বড় করুণ। কর্মজীবনে বহু কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখার পরও শেষজীবনে এসে পোড়া অন্ধকার ঘরেই তার দিনকাল কাটছে।
ঘটনার শুরু ১৯৪২ সালে। এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় দিনে যে সময় ভাশিষ্ঠা নারায়ণ সিংয়ের জন্ম হলো সে সময়ই ভারতমাতার কপালে আরেকটি সাফল্যের তিলক পরা হয়ে গেলো। বসন্তপুরের এক জীর্ণ পরিবারে জন্ম নিয়েও ভাশিষ্ঠা তার কৃতিত্বের জোরে চলে গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্টের নাসা পর্যন্ত। তারপর আবার মাতৃভূমির ডাকে ফিরে এসেছিলেন ভারতে। সেই তার অন্ধকারের পথে যাত্রা শুরু।
ছোটবেলা থেকেই একজন ভালো ছাত্র হিসেবে নাম কুড়ান ভাশিষ্ঠা। প্রাইমারি শিক্ষা শেষ করার পর তাকে রাঁচির নেতারহাট রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে ভর্তি করানো হয়। ১৯৫৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় রেকর্ডসংখ্যক নম্বর নিয়ে পুরো ভারতে প্রথম হন তিনি। ১৯৬১ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাতেও একই ফলাফল।
তার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে তাকে পাটনার বিজ্ঞান কলেজে অনার্সে ভর্তি করানো হয়। বিষয় ছিলো ম্যাথমেটিকস। এখানেই তার সঙ্গে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার অঙ্কের প্রফেসর জন ক্যালির পরিচয় ঘটে। একবার কলেজে গণিত বিষয়ে একটি সেমিনার হচ্ছিলো। ঘটনাক্রমে সেখানে জন ক্যালি উপস্থিত ছিলেন। সেমিনারে প্রফেসর ক্যালি গণিতের পাঁচটি সমস্যা উপস্থাপন করে উপস্থিত সবাইকে তা সমাধানের আহ্বান জানান। উপস্থিত ভাশিষ্ঠা পাঁচটি সমস্যারই নানারকম সমাধান প্রদান করেন। এই ঘটনা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় ভাশিষ্ঠার। প্রফেসর ক্যালি বাকি পড়াশোনা আমেরিকায় গিয়ে সম্পন্ন করার প্রস্তাব দিলেন ভাশিষ্ঠাকে। একইসাথে ভাশিষ্ঠার জন্য স্কলারশিপ, এমনকি প্লেনভাড়ার ব্যবস্থাও করলেন তিনি।
১৯৬৯ সালে সর্বোচ্চ সম্মান নিয়ে ভাশিষ্ঠা তার পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার পিএইচডি থিসিসের বিষয়বস্তু ছিলো, ‘Reproducing Kernels and Operators with Cyclic Vector’। একটা সময় ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়াতেই অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় তাকে। এর কিছুকাল পরে ভাশিষ্ঠা আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসায় যোগদান করেন।
ভাশিষ্ঠার জীবনের বৃহস্পতি তখন তুঙ্গে অবস্থান করছে। জন্মস্থান বিহারের সব ধরণের যুবকদের কাছে তিনি তখন এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। বিবাহযোগ্য কন্যার বাবাদের কাছে ভাশিষ্ঠা নারায়ন সিংয়ের চেয়ে সোনার টুকরো ছেলে আর মেলে না। ফলাফল, রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে ভাশিষ্ঠার জন্য বিবাহের প্রস্তাব আসতে শুরু করলো। অবশেষে ১৯৭২ সালে বাবা-মায়ের পছন্দে এক সরকারি ডাক্তারের কন্যাকে বিয়ে করেন ভাশিষ্ঠা। বিয়ের এক মাসের মাথাতেই বর-কনে আমেরিকায় পাড়ি জমান।
ওই সময় ভাশিষ্ঠার কিছু মানসিক সমস্যা দেখা দিতে থাকে। পরবর্তীতে প্রমাণিত হয় ভাশিষ্ঠা সিজোফ্রোনিয়ার রোগী ছিলেন। ধারনা করা হয়, বিয়ের পর পরই তার মধ্যে সিজোফ্রোনিয়ার লক্ষণগুলো স্পষ্ট হতে থাকে। চিকিৎসা হিসেবে গোপনে পিল নেন ভাশিষ্ঠা। তবে ঘরের কর্ত্রীর কাছে এই খবর গোপন থাকেনি বেশি দিন। সমস্যার শুরু এর পর থেকেই। স্বামীর এই অসুস্থতা মেনে নিতে পারেননি ভাশিষ্ঠার স্ত্রী। ফলে দুজনের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে।
১৯৭৪ সালে ইন্ডিয়া ফিরলেন ভাশিষ্ঠা। জন্মভূমিকে প্রতিদান দেয়ার আশা নিয়ে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে শিক্ষকতা শুরু করলেন। কিছুদিন পর মুম্বাইয়ের টাটা ইন্সটিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে এবং এরপর কোলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিটিউটে শিক্ষকতা করেন তিনি।
এই সময়ে ভাশিষ্ঠার মানসিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। এক পর্যায়ে তার স্ত্রী বাবার বাড়ি গিয়ে আর ফিরে আসবে না বলে জানায়। ফলাফল ১৯৭৬ সালে সংসারে বিচ্ছেদ ঘটে। এরপরই মূলত পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েন ভাশিষ্ঠা। তার মানসিক সমস্যাগুলো প্রকট হয়ে দেখা দিতে থাকে। শেষপর্যন্ত তাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানো ছাড়া পরিবারের সামনে আর কোনো পথ রইলো না।
ভাশিষ্ঠাকে সিজোফ্রোনিয়ার চিকিৎসা দেয়া হতে থাকে। ১৯৮৫ সালে, দীর্ঘ একটা সময় চিকিৎসা গ্রহণের পর; হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেন তিনি।
এর দুই বছর পর, গড়পড়তা এক দিনে হঠাৎ বাড়ি থেকে উধাও হলেন ভাশিষ্ঠা। উধাও মানে উধাও। তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না। বিহারসহ আশেপাশের রাজ্য খুঁজে খুঁজে হয়রান ভাশিষ্ঠার ভাইয়েরা। কোথাও নেই ভাশিষ্ঠা নারায়ন সিং। যেনো এই নামে কোনো ব্যক্তিই ছিলো না ভারতবর্ষে। পুরোই যেনো ভোজবাজি, এক লহমায় নিজ ঘর থেকে নাই হয়ে গেলেন বিহারের হিরো।
পত্রপত্রিকায় ভাশিষ্ঠার অন্তর্ধান নিয়ে অনেক লেখালেখি হলো। সারা ভারত জুড়ে হৈচৈ পড়ে গেলো জীবন্ত এই কিংবদন্তি গণিতবিদের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে। কাজের কাজ কিন্তু কিছুই হলো না। নিখোঁজ ভাশিষ্ঠা নিখোঁজই রইলেন।
১৯৮৯ সালের এক বিকেল। চার বছর গত হয়েছে। পরিবারের সদস্যরা ভাশিষ্ঠার শোক কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে ততোদিনে। এরই মধ্যে কিছু লোক এসে খবর দিলো ভাশিষ্ঠার মতো দেখতে এক লোককে দেখা গেছে। লোকটি পথের পাশের ডাস্টবিন থেকে খাবার খাচ্ছিলো। ডাস্টবিন আর বিহারের অহংকার –বিষয় দুটো পাশাপাশি যায় না বলেই হয়তো কেউ প্রথমে এতোটা পাত্তা দিলো না খবরটাকে।
কিন্তু ভাইকে ফিরে পাওয়ার আশায় লোকদের কথামতো ওই ডাস্টবিনের কাছে গেলেন ভাশিষ্ঠার ভাই প্রসাদ সিং ভাশিষ্ঠা। শুকনো হাড় জিরজিরে যে লোকটাকে ডাস্টবিনে পাওয়া গেলো তাকে নিজের ভাই বলে মেনে নিতে কষ্টই হচ্ছিলো প্রসাদের। কিন্তু বাস্তব বড় নির্মম। বিহারের তথা পুরো ভারতের অহংকার ডাস্টবিনে বসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খাবার খাচ্ছিলেন। কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে, ভাশিষ্ঠা তার বিচ্ছেদ হওয়া স্ত্রীর গ্রামের ডাস্টবিনেই এই চার বছর কাটিয়েছেন!
ডাস্টবিন থেকে খুঁজে পাওয়ার পর ভাশিষ্ঠা
এরপরের ঘটনা অনেকটা সিনেমার মতোই। দীর্ঘ সময় পর ভাশিষ্ঠাকে খুঁজে পাওয়ার পর পত্রিকায় আবার তাকে নিয়ে নানান ধরনের ফিচার ছাপা হলো। একসময় সরকারি দলের গোচরে পড়লেন বিহারের এই অহঙ্কার। ভোটের রাজনীতির চক্করেই হোক কিংবা জনকল্যাণ কাজের সূত্র ধরেই হোক, মূখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ এগিয়ে এলেন ভাশিষ্ঠার চিকিৎসায়। তাকে ব্যাঙ্গালোরে নিয়ে যাওয়া হলো। ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বখ্যাত বেশ কয়েকটি হাসপাতালে তাকে চিকিৎসা দেওয়ার পর তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়।
ভাশিষ্ঠা পরিবারের ছোট সন্তান দশরথ সিং জানান, এখন তার ভাই পুরোপুরি সুস্থ আছেন। তাকে সবসময় পূর্ণ যত্নে রাখা হচ্ছে।
সবচেয়ে আশার কথা হল, ভাশিষ্ঠাকে একজন সম্মানিত গবেষক ও প্রফেসর হিসেবে কাজের পরিবেশ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে ভারতের ভূপেন্দ্র নারায়ণ মণ্ডল বিশ্ববিদ্যালয়। আশা করা হচ্ছে, কাজের পরিবেশ পেলে আবার নিজেকে পুরোপুরিভাবে ফিরে পাবেন ভাশিষ্ঠা। যা আক্ষরিক অর্থে পুরো পৃথিবীর জন্যই মঙ্গলজনক হবে।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.