বাড়ছে নারী নির্যাতন: পোশাক নয় চাই মানসিকতার পরিবর্তন
- Details
- by মাহবুবা আক্তার স্মৃতি
ইদানিং রাতে ঘুমোতে পারি না। কোনো কিছুর শব্দ শুনলেই ভয়ে কুঁকড়ে যাই। এই বুঝি নরখাদকগুলো আমার ঘরেও তাদের লোভাতুর দৃষ্টি ফেলছে! এই বুঝি কতগুলো দানবের হাত সর্বস্ব কেড়ে নিতে এগিয়ে আসছে! এই বুঝি কোনো বাচ্চা মেয়ের চিৎকার কানে ভেসে এলো! এই বুঝি অসহায় বাবা-মার চাপা আর্তনাদ আমাকে দুর্বল, বেশ দুর্বল করে ফেললো!
সত্যিই ভয় পাই। আজকাল তো ঘর থেকে বের হবো মনে হলেই কেঁদে ফেলি। কি জানি, কোথায় কী ঘটে আবার! বান্ধবীদের সাথে দিনের বেলাতেই কোথাও যেতে যেখানে ভয় পাই, সেখানে সন্ধ্যার পর ঘরের বাইরে বের হবো! অসম্ভব!
বলছিলাম, সমাজে নিরাপত্তাহীনতায় আমরা যারা (নারী) রয়েছি, তাদের কথা। অবাক হবার কিছু নেই। এটাই চরম সত্য। উপরের কথাগুলো কিন্তু শুধু আমার নয়, বর্তমান নারী সমাজের প্রকৃত দৃশ্য এটা। কেন জানেন? আজকাল সবজায়গাতেই আমরা (নারীরা) প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শারীরিকভাবে নির্যাতিত, ধর্ষিত, যৌন হয়রানীসহ বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। তার মধ্যে বর্তমানে 'ধর্ষণ' সব থেকে ঘৃণ্য আর আলোচিত বিষয়। নারীরা আজ কোথাও নিরাপদ নয়। ঘরে-বাইরে, চার দেয়ালের ভেতরে, পথে-ঘাটে, স্কুলে যাবার কিংবা ফেরার সময়, চলতি পথে, রাস্তায়, বাসে, শপিংমলে সব জায়গাতেই মেয়েরা এখন শারীরিকভাবে যৌন হয়রানীর শিকার হচ্ছে। এমন কি মেয়ে শিশুটিও বাদ যাচ্ছে না এই জঘন্যতম নরপশুদের হাত থেকে!
মাতুয়াইলের ৭ বছরের শিশু রুনি, দিনাজপুরের ৫ বছরের শিশু পূজা (যার লজ্জাস্থান ব্লেড দিয়ে কেটে বড় করা হয়েছিল), ৮ বছরের সিনথিয়া, ১১ বছরের একটি মেয়েকে স্কুলঘরে আটকে রেখে ৮ জন মিলে ধর্ষণ করে! মাকে বেঁধে রেখে শিশু মেয়েকে ধর্ষণের খবর এখন নিয়মিত শোনা যায়। এমন আরও অনেক উদাহরণ রয়েছে।
আমরা এমন এক রাষ্ট্রে বসবাস করছি, যেখানে একজন অসহায় বাবা বিচার না পেয়ে ধর্ষিত হওয়া মেয়েটিকে নিয়ে ট্রেনের নিচে আত্মহত্যা করেন। আমরা এমনই এক সমাজে বসবাস করছি, যেখানে ধর্ষকরা সমাজে গা দুলিয়ে চলাফেরা করে, আর সমাজ তাদের মাথায় তুলে নাচে। তাদের অপরাধকে নিতান্তই খেলা ভেবে ধামাচাপা দিয়ে মিটিয়ে ফেলা হয়। হ্যাঁ, এমন নরাধম সমাজে আমরা বাস করছি, যেখানে রাষ্ট্র নির্বাক ভূমিকা পালন করে। ধর্ষিত হওয়া পরিবারটি চার দেয়ালের ভেতরে ঠুকরে ঠুকরে মরে। সমাজ শুধু তাদের নিন্দা জানায়।
এসব ভাবতেও ঘৃণা লাগে। মাঝে মাঝে অনেক অসহায় নারীর মুখ থেকে শুনতে পাই, আমার জন্মটাই বুঝি পাপ ছিল! তাই এমন সমাজে জন্ম!' সত্যিই তো, যেখানে ধর্ষিতা মেয়েটি বিচার চাইতে গিয়ে আদালতের সামনে আবারও ধর্ষিত হয় উপস্থিত জনসম্মুখের কটু প্রশ্নের আঘাতে! সেখানে মেয়েরা আর কী বা বলতে পারে? হায় সমাজ! ধিক তোমাকে। এমন এক বিবর্জিত সমাজে বাস করি, যেখানে তনুসহ অসংখ্য মেয়ের হত্যাকারীরা অবাধে চলাফেরা করে। আর নির্যাতিত হওয়া পরিবারটিকে সমাজ ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়! এমন আরো অনেক নজির রয়েছে আমাদের সমাজে, যেখানে ৪র্থ শ্রেণীর একটি মেয়ের পেটে থাকে ৬ মাসের বাচ্চা। আবার হুমকিও দেওয়া হয়, কাউকে বলে দিলে পরিবারকে শেষ করে দিবে! কার মদদে অপরাধী সমাজ বারবার অপরাধ করছে? পেছনে নিশ্চয় এমন কিছু শক্তি কাজ করছে, যার ফলে অবাধে কতগুলো নিম্নশ্রেণীর পশুজাত স্বভাবের লোক অপরাধ করে যাবার সাহস পাচ্ছে! রাষ্ট্র নিশ্চয় তাদের প্রতিরোধ করে আমাদের আশার বাণী শোনাবেন!
মেয়েরা আজ কোথায় ভালোভাবে চলতে পারছে? রাস্তায়, বাসে, শপিংমলে...সবখানে মেয়ের ঘ্রাণ পেলেই হলো, পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ধাক্কা দেয়া, গায়ে হাত দেয়া, ইচ্ছে করে গায়ে এসে পড়া, গা ঘেষে দাঁড়ানোসহ আরও অনেক শারীরিক ভাবে হয়রানী করা.... কিছু পশুপ্রকৃতির লোকের স্বভাব। সব থেকে খারাপ লাগে, পাশের সিটে বসা মধ্য বয়সি লোকটাও যখন সুযোগ খোঁজে। ঘেন্না চলে আসে পুরুষ সমাজে। নারীকে নিজের মায়ের মতো, মেয়ের মতো কিংবা বোনের চোখে দেখতে সমস্যা কোথায়? বলছি না, সব পুরুষই খারাপ। কিন্তু কলুষিত হতে কতক্ষণ? বাংলাদেশে বর্তমানে যেভাবে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, যদি সঠিক ব্যবস্থা না নেয়া হয়, উপযুক্ত শাস্তি যদি ধর্ষকদের না দেয়া হয়, তবে কয়েকমাসের মধ্যেই হয়তো সে রেকর্ড ভারতকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে।
কেন ধর্ষণ হচ্ছে? এই প্রশ্ন করলে প্রথমেই জবাব আসে, মেয়েদের অশালীন পোশাক, চাল-চলন তার জন্য দায়ী। আশ্চর্য লাগে, কোন সমাজে বাস করি আমরা! যদি পোশাক আর চাল-চলনই দায়ী হয়, তবে দুই, আড়াই, তিন, পাঁচ বছর এমনকি ৮ মাসের শিশুকে কেন ধর্ষন করা হলো, এ প্রশ্নের উত্তর দেবে কে? আরে ওরা তো জীবনের ভালো-মন্দ বুঝার আগেই সব হারিয়ে ফেলেছে। স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকারতো অনেক আগেই কেড়ে নেয়া হয়েছে। তাহলে কিভাবে আপনারা মেয়েদের পোশাকের দিকে আঙুল তোলেন? লজ্জা হওয়া দরকার। যদি পোশাকই শুধু কারণ হতো, তাহলেও এতো চাপা চিৎকার কানে বাজতো না। পর্দা করে যেসব নারীরা চলছে, তারা কি ঐসব নপুংসক পশুর কুদৃষ্টি থেকে রক্ষা পাচ্ছে? মোটেও না। গার্মেন্টসে কাজ করা নারী যখন সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বাড়ি ফিরতে চায়, সেও চলন্ত বাসে ধর্ষিত হয়। তাহলে কোনটাকে আপনারা কারণ দেখাবেন বলুন? পশুপ্রবৃত্তি স্বভাব যাদের, তাদের কোন কারণ লাগে না। পোশাক নয়, ধর্ষণ বন্ধ হওয়ার জন্য আমাদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন আগে দরকার।
তবুও আমরা কিছু কারণ দেখাতেই পারি। যেমন: পারিবারিক শিক্ষা, নৈতিকতা জ্ঞানের অভাব, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে না চলা, বাবা-মার সন্তানের প্রতি উদাসীন মনোভাব, ছেলের অপরাধ ঢাকার অপচেষ্টা, সামাজিক পরিবেশও এরজন্য অন্যতম দায়ী। এছাড়া আইনের দুর্বল কাঠামো, অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি না দেয়া, পক্ষপাত দুষ্ট আদালত, রাষ্ট্রের নিরব ভূমিকা, বড় কোনো শক্তির মদদ, অসচেতন জনগোষ্ঠী, শিক্ষার অভাব, বিদেশি সংস্কৃতির অবাধ বিচরণ, ইত্যাদি বিভিন্ন কারণ। তবে অনেক ক্ষেত্রে মেয়ের পরিবারকেও দায়ী করা যায়। বিশেষ করে গ্রামের দিকে, মেয়ের বাবা-মা প্রাথমিক অবস্থাতেই কিংবা এমন কোনো হতে পারে আঁচ করতে পারলেও অনেক সময় চুপ করে থাকে লজ্জার ভয়ে। এছাড়াও আরও অনেক কারণ রয়েছে।
উপরে যে কারণগুলো উল্লেখ করা হয়েছে তার বিস্তারিত আলোচনা করতে গেলে লেখা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। তবে, এসব শোনার মতো এতো সময় আমাদের সমাজের কই! হয়তো ভাবতে পারেন, এসব পুরনো আলোচনা। হ্যাঁ পুরনো, তবে নিত্য ঘটনা। তাই অন্যদের সাথে সাথে আমাকেও কলম ধরে বর্তমানে আলোচিত একটি বিষয় নিয়েই কিছু বলতে হলো।
যদি বলেন কারণ তো দেখালাম, এবার সমাধান দিতে। সমাধান আমার চিহ্নিত করা কারণগুলোর মধ্যেই রয়েছে। যা যা বলেছি, তা সমাধান করতে পারলেই হয়তো ধর্ষনের মতো ঘৃণ্য কাজ থেকে নারী সমাজ মুক্তি পাবে।
বাবা-মাকে বলবো, প্লিজ নিজের সন্তানের প্রতি মনোযোগী হোন। তাদের অপরাধগুলো ঢাকার চেষ্টা না করে বরং কিভাবে তাদের সঠিক পথে নিয়ে আসা যায়, সে ব্যবস্থা করুন। অন্যদিকে পুরুষ সমাজের কাছে অনুরোধ, নারীর দিকে অন্য দৃষ্টিতে তাকাবেন না। তারাও তো মানুষ, তবে নারী। নারী বলেই কি রোজ ধর্ষিত হতে হবে! এরাও তো আপনাদের বোনের মতো, মেয়ের মতো, মায়ের মতো। তাহলে কেন ধর্ষনের মতো এতো নিম্নশ্রেণীর ঘটনার সম্মুখীন বারবার হতে হবে? কেন, একটা অবুঝ শিশু জীবনের স্বাদ, আনন্দ বুঝার আগেই তার ফুলের মতো সুন্দর ও নিষ্পাপ জীবন শেষ হয়ে যাবে? তুমি শুনছো কি সমাজ? কবে তোমার বিবেক জাগ্রত হবে?
লেখক: মাহবুবা আক্তার স্মৃতি
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ (৩য় বর্ষ)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.