বিশ্ববাজারে সস্তা, দেশে চড়া: সয়াবিন তেলের দামে পুড়ছে ভোক্তা

আন্তর্জাতিক বাজারে গত তিন বছরের মধ্যে সয়াবিন তেলের দাম সর্বনিম্ন পর্যয়ে নেমে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশের ভোক্তারা এই সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তাদের কিনতে হচ্ছে তুলনামূলক অনেক বেশি দামে। ব্যবসায়ীরা এর কারণ হিসেবে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং ব্যাংক থেকে সময়মতো ঋণ না পাওয়ার অজুহাত দিচ্ছেন।

সয়াবিন তেলের ছবি

তবে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এই দাবি নাকচ করে দিয়েছে। সংস্থাটির হিসাবে, আমদানি খরচ ও অন্যান্য ব্যয় বাদ দিলেও সম্প্রতি লিটারে ১৪ টাকা দাম বাড়ানোর পর ব্যবসায়ীরা প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনে কমপক্ষে ১২ টাকা লাভ করছেন। ক্যাবের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে ব্যবসায়ীরা ডলার, ব্যাংক বা কাস্টমসের অজুহাত দেন, কিন্তু দাম বাড়লে বাতাসের আগে তা কার্যকর করেন। এই দ্বিমুখী আচরণ বন্ধ হওয়া দরকার।’ তিনি দাম বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক বলে অভিহিত করেন।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সাল থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেল, পাম অয়েল ও সয়াবিন বীজের দাম ধারাবাহিকভাবে কমছে। ২০২২ সালে প্রতি টন সয়াবিন তেলের গড় দাম ১,৬৬৭ ডলার থাকলেও ২০২৪ সালে তা ১,০২২ ডলারে নেমে এসেছে। এমনকি চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে গড় দাম ছিল ১,০৪০ ডলার এবং এপ্রিলে আরও কমেছে। একই চিত্র পাম অয়েল ও সয়াবিন বীজের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, যেখানে দাম উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে।

কাস্টমসের তথ্য বিশ্লেষণ করে ক্যাব দেখিয়েছে, গত ছয় মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা প্রতি কেজি অপরিশোধিত ভোজ্যতেলের শুল্কায়ন মূল্য ছিল গড়ে ১৩৬ টাকা। এর সঙ্গে পরিবহন ও পরিশোধন বাবদ সর্বোচ্চ ২০ টাকা এবং শুল্ক-কর-ভ্যাট বাবদ ২১ টাকা যোগ করলে প্রতি লিটারের মোট খরচ দাঁড়ায় ১৭৭ টাকা। অথচ সরকার ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে দাম নির্ধারণ করেছে ১৮৯ টাকা। এই হিসাবে প্রতি লিটারে ব্যবসায়ীদের লাভ থাকছে অন্তত ১২ টাকা।

দেশের অন্যতম শীর্ষ আমদানিকারক টি কে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতহার তসলিম অবশ্য ভিন্ন কথা বলছেন। তার মতে, ‘ট্যাক্স ও ভ্যাট পুনর্বহালের কারণে দাম বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার সুফল ডলারের দাম বৃদ্ধি ও ব্যাংক খাতের অস্থিরতার জন্য আমরা নিতে পারিনি।’ তিনি দাবি করেন, সরকার শুল্কহার পুনর্বহাল করায় লিটারে ২১ টাকা বাড়ার কথা থাকলেও বাড়ানো হয়েছে ১৪ টাকা, এবং এতেও তাদের লোকসান হচ্ছে।

তথ্য বলছে, গত সাড়ে তিন মাসে ২৩টি জাহাজে করে প্রায় ৩ লাখ ৭ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম অয়েল এবং ২ লাখ ২৭ হাজার টন সয়াবিন বীজ আমদানি করা হয়েছে। এর বেশিরভাগই আমদানি হয়েছে ২০২৪ সালে, যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম সর্বনিম্ন ছিল। টি কে গ্রুপ ও মেঘনা গ্রুপ এই সময়ে সবচেয়ে বেশি আমদানি করেছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, ১৯ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত ভোজ্যতেলের কোনো জাহাজ বন্দরে আসেনি, যা দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

দেশে ভোজ্যতেলের বাজার মূলত কয়েকটি বড় শিল্প গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড ও স্মাইল ফুড প্রোডাক্টস – এই পাঁচ প্রতিষ্ঠান বাজারের প্রায় ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই মূলত দাম নির্ধারিত হয়। দেশে ২২টি রিফাইনারি থাকলেও বেশিরভাগ চাহিদা পূরণ করছে এই শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি কোম্পানি।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে ভোজ্যতেলের দাম কমানো হয়েছে মূলত সরকারের শুল্ক ছাড়ের কারণে। শুল্ক ছাড় প্রত্যাহার হলেই দাম বাড়িয়ে দেন আমদানিকারকরা। গত এক বছরে বেশ কয়েকবার দাম ওঠানামা করেছে এবং সর্বশেষ ৩১ মার্চ শুল্ক ছাড়ের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর লিটারে ১৪ টাকা দাম বাড়ানো হয়।

এদিকে, দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে এখনো ভোজ্যতেলের সরবরাহ পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার পর আমদানিকারকরা সরবরাহ আদেশ (এসও) বিক্রি কমিয়ে দেওয়ায় এবং সময়মতো পণ্য সরবরাহ না করায় বাজারে ঘাটতি তৈরি হয়েছিল, যার সুযোগে কয়েক মাস বাড়তি দামে তেল বিক্রি হয়েছে।

দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দামের এই অস্থিরতা এবং আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে বিরাট ফারাক ভোক্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। ব্যবসায়ীদের যুক্তি এবং ক্যাবের পাল্টা যুক্তির এই দ্বন্দ্বে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমছে না।

সমকাল অবলম্বনে