দেশের পরিস্থিতি ও করণীয়: প্রধান উপদেষ্টাকে যা জানাল বিএনপি

দেশের চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং ভবিষ্যৎ করণীয় বিষয়ে নিজেদের সুচিন্তিত মতামত ও একগুচ্ছ দাবি জানিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বুধবার (১৬ এপ্রিল) দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এই চিঠি হস্তান্তর করেন।

বৈঠকের ছবি

‘দেশে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দ্রুত করণীয় কিছু বিষয়ে মতামত ও পরামর্শ’ শীর্ষক এই চিঠিতে বিএনপি সাম্প্রতিক ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থানের পটভূমি এবং এর ফলে সৃষ্ট নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় দলের অবস্থান তুলে ধরেছে।

টিঠিতে দলটি উল্লেখ করেছে যে, এই অভ্যুত্থান একটি ‘ফ্যাসিবাদী’ শাসনের অবসান ঘটিয়েছে, যার জন্য দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে অসংখ্য নেতা-কর্মী জীবন দিয়েছেন, গুম ও খুনের শিকার হয়েছেন এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন। বিএনপি এই অর্জনকে জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে এবং একটি টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে।

চিঠিতে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আশু করণীয় হিসেবে বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:

• পূর্ববর্তী সরকার ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে উঠা গণবিরোধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধ, দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থ পাচারের অভিযোগের দ্রুত বিচার এবং পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনা।
• জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ এবং আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা।
• দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি ঘটানো।
• দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া।

একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করে বিএনপি এই প্রক্রিয়ায় সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। তবে, দলটি ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’ বা ‘আগে সংস্কার পরে গণতন্ত্র’ – এই ধরনের তত্ত্বকে প্রথ্যাখান করে বলেছে যে, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার মাধ্যমেই প্রকৃত উন্নয়ন ও কার্যকর সংস্কার সম্ভব। বিএনপি তাদের শাসনামলে গৃহীত বিভিন্ন সংস্কারমূলক পদক্ষেপ এবং রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখার কথা উল্লেখ করে যেকোনো যৌক্তিক আলোচনাকে স্বাগত জানানোর কথা বললেও, সংস্কারের নামে সময়ক্ষেপণ করে নির্বাচন বিলম্বিত করার যেকোনো প্রচেষ্টার বিরোধিতা করার ইঙ্গিত দিয়েছে।

চিঠিতে পূর্ববর্তী দুটি চিঠির (২১ নভেম্বর ২০২৪ ও ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) প্রসঙ্গ উল্লেখ করে জানানো হয় যে, সেগুলোতে উত্থাপিত উদ্বেগ ও পরামর্শ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। এছাড়া, বৈষম্যের শিকার ৭৬৪ জন কর্মকর্তার পদোন্নতি হলেও পদায়ন না হওয়ায় প্রশাসনিক কাজে বিঘ্ন ঘটছে দাবি করে তাদের দ্রুত পদায়নের আহ্বান জানানো হয়েছে।

বিএনপি প্রধান উপদেষ্টা ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের বক্তব্যে ‘সমন্বয়হীনতা’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যা জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে বলে তারা মনে করে। দলটি অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি আস্থা রাখার কথা বললেও, এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছে।

সবশেষে, বিএনপি জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারের গুরুদায়িত্ব পালনে প্রধান উপদেষ্টাকে আহ্বান জানিয়ে আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে। একইসঙ্গে, এনআইডি প্রকল্প নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যস্তকরণ, নির্বাচনী এলাকা পুনঃনির্ধারণের আইনি জটিলতা নিরসন এবং ১/১১ ও বিগত সরকারের আমলে দায়েরকৃত 'হয়রানিমূলক' মামলা প্রত্যাহারেরও দাবি করা হয়েছে।