ব্যাংক খাতে প্রভিশনের ঘাটতি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে

দেশের ব্যাংকিং খাতে প্রভিশনের ঘাটতি প্রথমবারের মতো এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে এই ঘাটতির পরিমাণ ৩৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাংকগুলোতে, বিশেষ করে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

প্রতীকী ছবি - সংগৃহীত

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের শেষে প্রভিশনের ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,০৬,১৩০ কোটি টাকায়, যা সেপ্টেম্বরে ছিল ৫৫,৩৭৮ কোটি টাকা এবং জুনে ৩১,৫৪৯ কোটি টাকা।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর, দীর্ঘদিন ধরে চাপা দেওয়া আর্থিক অব্যবস্থাপনা এবং অনিয়ম এখন প্রকাশ্যে আসছে।

চাপের মুখে থাকা ব্যাংকিং খাত এখন বিশাল পরিমাণ খেলাপি ঋণের বোঝা বহন করছে, যা আগে তথ্য কারচুপির মাধ্যমে গোপন করা হয়েছিল।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য পরিস্থিতি বিশেষ করে উদ্বেগজনক। মাত্র তিন মাসের মধ্যে প্রভিশনের ঘাটতি তিনগুণেরও বেশি বেড়ে ডিসেম্বরে ৪৮,৮৮৩ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা সেপ্টেম্বরে ছিল ১৫,৮৩১ কোটি টাকা এবং জুনে ১৪,০৮৬ কোটি টাকা। বর্তমানে মোট প্রভিশন ঘাটতির ৪৬ শতাংশই এই ব্যাংকগুলোর।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর প্রভিশনের ঘাটতি ডিসেম্বরে বেড়ে ৫৭,৯৬৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা জুনে রেকর্ড করা ১১,৪২৮ কোটি টাকার পাঁচগুণ বেশি। সেপ্টেম্বরে এটি ছিল ৪০,২০৪ কোটি টাকা।

খেলাপি ঋণ মোকাবেলার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রভিশন বজায় রাখতে হয়। যখন তারা তা করতে ব্যর্থ হয়, তখন প্রভিশনের ঘাটতি দেখা দেয়, যা আর্থিক ধাক্কা সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অক্ষমতা প্রকাশ করে।

এই অব্যাহত প্রভিশনের ঘাটতি ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ, দুর্বল মূলধন এবং ঋণ আদায়ে অক্ষমতার প্রত্যক্ষ ফলাফল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মাত্র এক বছরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ দুই লাখ কোটি টাকা বেড়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের শেষে ৩.৪৫ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।

খেলাপি ঋণের পরিমাণ সেপ্টেম্বরে ২,৮৪,৯৭৭ কোটি টাকা, জুনে ২,১১,৩৯১ কোটি টাকা, মার্চে ১,৮২,২৯৫ কোটি টাকা এবং ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ১,৪৫,৬৩৩ কোটি টাকা ছিল।

২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, মোট ব্যাংক ঋণের প্রায় ২০ শতাংশ — ১৭.১১ লাখ কোটি টাকা — খেলাপি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে, খেলাপি ঋণ ডিসেম্বরে ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে, যা সেপ্টেম্বরে ছিল ১,৪৯,৮০৬ কোটি টাকা। একই সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১,২৬,১১১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১,৩৬,৬১৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে, ব্যাংকগুলোকে মানসম্মত ঋণের জন্য ০.৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন বজায় রাখতে হয়। তবে, শ্রেণিবদ্ধ ঋণের ক্ষেত্রে, সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের জন্য ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের জন্য ৫০ শতাংশ এবং 'লস' বা 'ব্যাড' ঋণের জন্য ১০০ শতাংশ প্রভিশন প্রয়োজন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রভিশন ব্যাংকের মুনাফা থেকে আসার কথা, কিন্তু ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণের কারণে অনেক ব্যাংক এই প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে পারছে না।

প্রভিশন বজায় রাখতে ব্যর্থতা অনিয়ন্ত্রিত ঋণ অনিয়ম, দুর্নীতি এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যর্থতার জেরে সৃষ্ট গভীর সংকটকে রেখাঙ্কিত করে, তারা বলেন।

তারা আরও বলেন, বছরের পর বছর ধরে বেপরোয়া ঋণদান, যা প্রায়শই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত, একটি আর্থিক কালো গর্তের সৃষ্টি করেছে যা স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ।

নিউএজ অবলম্বনে