রাজধানী ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকায় একের পর এক গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বেআইনিভাবে নিম্নমানের গ্যাস সিলিন্ডার উৎপাদন ও বিক্রি হাজার হাজার মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং আইন প্রয়োগের দাবি জোরালো হয়েছে।

gas cylinderফাইল ছবি

সাভারে টানা বিস্ফোরণ:

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, সাভারের আশুলিয়ায় একটি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এক দম্পতি এবং তাদের পাঁচ বছর বয়সী শিশু গুরুতর আহত হয়। এর আগে, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, আশুলিয়ার আরেকটি বিস্ফোরণে একই পরিবারের ১১ জন সদস্য আহত হন, যাদের মধ্যে নারী ও শিশুও ছিল। এই ঘটনাগুলো অনিরাপদ গ্যাস সিলিন্ডারের ভয়াবহতা ফুটিয়ে তুলেছে, যা এখনও বাংলাদেশের অনেক বাড়ি এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত হচ্ছে।

১৪ ফেব্রুয়ারির বিস্ফোরণের পর, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা প্রোটোকল মূল্যায়ন এবং অনুরূপ দুর্ঘটনা রোধে কঠোর নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বিবেচনা করছে। বাসিন্দাদের গ্যাস সিলিন্ডার সাবধানে ব্যবহার করার এবং যেকোনো সন্দেহজনক লিক বা নিরাপত্তা ঝুঁকি কর্তৃপক্ষকে জানানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

আগুন ও সিলিন্ডার বিস্ফোরণ:

ত্রুটিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডারের ঝুঁকি বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার সংকটের একটি অংশ। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সারা দেশে ২৬,৬৫৯টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, যা প্রতিদিন গড়ে ৭৩টি অগ্নিকাণ্ডের সমান। এই ঘটনাগুলিতে ৩৪১ জন আহত এবং ১৪০ জন মারা যান। মোট সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ৪৪৬.২৭ কোটি টাকা।

এই অগ্নিকাণ্ডগুলোর মধ্যে:

  • ৩৪% (৯,০৬৯টি ঘটনা) বৈদ্যুতিক ত্রুটির কারণে ঘটেছে।
  • ১৫.৫২% (৪,১৩৯টি ঘটনা) জ্বলন্ত সিগারেট বা বিড়ির কারণে ঘটেছে।
  • ১১.৪৬% (৩,০৫৬টি ঘটনা) চুলা সংক্রান্ত দুর্ঘটনার কারণে ঘটেছে।
  • ২.৯৫% (৭৮৯টি ঘটনা) অগ্নিসংযোগের কারণে ঘটেছে।
  • ২.৮৪% (৭৫৯টি ঘটনা) শিশুদের আগুন নিয়ে খেলার কারণে ঘটেছে।
  • ৭০৪টি ঘটনা গ্যাস সিলিন্ডার লিকের সঙ্গে সম্পর্কিত, আর ৪৪টি ঘটনা সরাসরি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণে ঘটেছে।

এই উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান সত্ত্বেও, বেআইনি গ্যাস সিলিন্ডারের অবৈধ ব্যবসা চলছে, যা ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলছে।

বেড়েই চলেছে বেআইনি গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবসা:

বেআইনি গ্যাস সিলিন্ডার উৎপাদন ও বিক্রি বাংলাদেশে একটি লাভজনক কিন্তু মারাত্মক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে, এই সিলিন্ডারগুলি অননুমোদিত কারখানায় উৎপাদিত হয় এবং কম দামে বিক্রি হয়, যা ঝুঁকি সম্পর্কে অজ্ঞ ভোক্তাদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে।

‘এই সিলিন্ডারগুলি প্রত্যয়িত সিলিন্ডারের মতো কঠোর নিরাপত্তা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যায় না,’ বলেন ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী। ‘বিস্ফোরণের ঝুঁকি অনেক বেশি, এবং আমরা জনগণকে অননুমোদিত বিক্রেতাদের কাছ থেকে সিলিন্ডার কিনতে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করছি।’

রান্নার জ্বালানি হিসেবে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) চাহিদা বেড়েছে। এই চাহিদার সুযোগ নিয়ে, বেআইনি উৎপাদনকারীরা নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করে পুরাতন সিলিন্ডার মেরামত করে, যা লিক, অগ্নিকাণ্ড এবং বিস্ফোরণের ঝুঁকি বাড়ায়। এই সিলিন্ডারগুলির কিছু প্রতিবেশী দেশগুলিতেও রপ্তানি করা হচ্ছে, যা নিয়ন্ত্রণকে আরও কঠিন করে তুলেছে।

লাইসেন্সিংয়ের ত্রুটি:

গ্যাস সিলিন্ডার আমদানি, উৎপাদন, সংরক্ষণ, বিতরণ এবং বিপণনের জন্য সরকারের পূর্বানুমতি নেওয়ার স্পষ্ট বিধিমালা থাকা সত্ত্বেও, এই নিয়মগুলি ব্যাপকভাবে উল্লঙ্ঘন করা হচ্ছে। চায়ের স্টল থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক্স দোকান - সর্বত্র এলপি গ্যাস সিলিন্ডার পাওয়া যায়, অনেক ক্ষেত্রেই অনুমতি ছাড়াই।

যাত্রাবাড়ীর গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবসায়ী সুমন তালুকদার দাবি করেন যে তার ছোট ব্যবসার জন্য কোন লাইসেন্সের প্রয়োজন নেই। ‘এটি ভোক্তাদের জন্য একটি সেবা,’ তিনি বলেন। তবে, সরকারি নীতি অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া এলপি গ্যাস বিক্রি করতে পারে না।

আইনত, একটি দোকান খুচরা বিক্রয়ের জন্য সর্বোচ্চ ১০টি গ্যাস সিলিন্ডার মজুত করতে পারে, তবে কেবলমাত্র বিস্ফোরক ও অগ্নিনির্বাপণ সেবা অধিদপ্তরের লাইসেন্সসহ। বিধিমালার ১৭ এবং ১৮ ধারা অনুযায়ী, উল্লঙ্ঘনকারীদের তিন বছরের কারাদণ্ড, জরিমানা এবং মাল জব্দ করার বিধান রয়েছে। তবে, অনেক বিক্রেতা লাইসেন্সিং প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকেন, আবার অনেকে পরিচালন পরিষদের লাইসেন্স প্রাপ্তিতে অত্যধিক ব্যয় এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার অভিযোগ করেন।

মারাত্মক পরিণতি:

নিম্নমানের এলপিজি এবং সঙ্কুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস (সিএনজি) সিলিন্ডার অনেক বিস্ফোরণের জন্য দায়ী, যার ফলে জীবনহানি এবং গুরুতর সম্পত্তির ক্ষতি হয়। যদিও সিলিন্ডার বিস্ফোরণ সম্পর্কে কোনো সার্বিক জাতীয় তথ্য নেই, মিডিয়া রিপোর্টে প্রায়শই এই ধরনের ঘটনা উঠে আসে।

অন্যান্য অনেক দেশের মতো, বাংলাদেশের সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি এলপিজিসিএলও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সিলিন্ডার ব্যবহার করে না, নিরাপত্তার কারণে আমদানির ওপর নির্ভর করে। এদিকে, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) ত্রুটিপূর্ণ সিলিন্ডার বাতিল করেছে, যার ফলে ভোক্তাদের কাছে অনিরাপদ সিলিন্ডার পৌঁছানো রোধ করার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

গ্যাস সিলিন্ডার, যদি সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়, তাহলে ৪০ বছর পর্যন্ত টিকতে পারে। তবে, বিধিমালা অনুযায়ী প্রতি ১০ বছর ব্যবধানে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে একটি নিরাপত্তা পরীক্ষা করার নিয়ম রয়েছে। এই ব্যবস্থা সত্ত্বেও, বেআইনি রিফিলিং ব্যবসা খোলাখুলিভাবে চলছে, যা ভোক্তাদের ঝুঁকির মধ্যে রেখেছে।

জনগণের ভয়:

ত্রুটিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যাপক উপস্থিতি ভোক্তাদের মধ্যে ভয় সৃষ্টি করেছে। মতিঝিলের বাসিন্দা আব্দুল করিম স্বীকার করেছেন যে মিডিয়ায় প্রায়শই বিস্ফোরণের খবর দেখার কারণে তিনি গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করতে ভয় পান।

‘এটি জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন,’ তিনি বলেন। ‘মানুষকে রক্ষা করার জন্য আমাদের সঠিক নিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং সচেতনতা অভিযানের প্রয়োজন।’

বিশেষজ্ঞরা বাজার থেকে ত্রুটিপূর্ণ সিলিন্ডার চিহ্নিত করে অপসারণের জন্য জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। তারা অননুমোদিত গ্যাস সিলিন্ডার রিফিলিং কারখানার বিরুদ্ধে জাতীয় স্তরে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর জোর দিয়েছেন।

সরকার কি কার্যকর পদক্ষেপ নেবে?

সরকার নিয়ন্ত্রণ কঠোর করার এবং নিরাপত্তা অভিযানের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কর্তৃপক্ষ বিতরণ ব্যবস্থা আরও কার্যকরভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য গ্যাস কোম্পানিগুলির সঙ্গে কাজ করছে। তবে, সারা দেশে অবৈধ সিলিন্ডার এখনও সহজলভ্য থাকায়, প্রশ্ন একটাই থাকে: আরেকটি দুর্ঘটনা ঘটার আগে কর্তৃপক্ষ কি এই বিপজ্জনক অবৈধ ব্যবসা নির্মূল করতে সক্ষম হবে?

ইউএনবি অবলম্বনে

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.