সিরিয়া কি নতুন আফগানিস্তান? - একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ

সিরিয়ায় সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন, বিশেষ করে আহমাদ আল-শারারাকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ, বিশ্বব্যাপী আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই সিরিয়ার পরিস্থিতির সঙ্গে ২০২১ সালে তালেবানের আফগানিস্তান দখলের তুলনা করছেন। এই প্রতিবেদনে, দুই দেশের মধ্যে মিল ও অমিলগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

সিরিয়া ও আফগানিস্তান

সিরিয়ার বর্তমান সংকটের শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। ১৯৮২ সালে হামায় গণহত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনা, যেখানে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে ১০,০০০ থেকে ৪০,০০০ সুন্নি মুসলমান নিহত হয়েছিল, দীর্ঘকালীন অস্থিরতার বীজ বপন করেছিল। ২০১১ সালে আরব বসন্তের পরিপ্রেক্ষিতে গণবিক্ষোভের মুখে বাশার আল-আসাদের সরকারের দমনমূলক নীতি এবং ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। এই দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত একটি ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়, যা লাখ লাখ মানুষের জীবন বিনষ্ট করে এবং কোটি কোটি মানুষকে শরণার্থীতে পরিণত করে। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বুঝতে না পারলে সিরিয়ার বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ অসম্পূর্ণ থাকবে।

এইচটিএস ও তালেবান: একটি তুলনামূলক চিত্র

আদর্শিক পার্থক্য: তালেবান দেওবন্দি ইসলামের অনুসারী, যা দক্ষিণ এশিয়ার একটি অনন্য ইসলামি ঐতিহ্য। অন্যদিকে, এইচটিএস সালাফি আন্দোলনের সঙ্গে যোগসূত্র ধারণ করে। যদিও তালেবান এবং এইচটিএস ইসলামের নামে শাসন করার দাবি করে, তাদের আদর্শিক ব্যাখ্যা এবং রাজনৈতিক লক্ষ্য উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন। এই পার্থক্য তাদের শাসনব্যবস্থা, সামাজিক নীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলে।

শাসন ও দুর্নীতি: বাশার আল-আসাদ এবং আশরাফ গনি – উভয় সরকারই ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ছিল। এই দুর্নীতি জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং বিদ্রোহের মূল কারণ হিসেবে কাজ করে। এইচটিএস এবং তালেবান উভয়ই দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি দিলেও, তাদের বাস্তব কার্যপ্রণালী এখনও পর্যবেক্ষণ করা বাকি।

জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক গতিশীলতা: আফগানিস্তান একটি বহুজাতিক দেশ যেখানে পশতুন, তাজিক, হাজারা ও উজবেকদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই চলছে। সিরিয়ায় আরব, কুর্দি এবং তুর্কি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা প্রবল। এই জাতিগত এবং সাম্প্রদায়িক বৈচিত্র্য উভয় দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে জটিল করে তুলেছে। এইচটিএস-এর উত্থান সিরিয়ায় সুন্নি শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে, যা নতুন সাম্প্রদায়িক গতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনীতি: তালেবান রাশিয়া এবং চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করছে। এইচটিএস, অন্যদিকে, তুরস্ক সহ পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু আফগানিস্তান ও সিরিয়া - উভয় দেশই বর্তমানে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অভাবে ভুগছে।

নারীর অধিকার ও সামাজিক নীতি: তালেবান নারীদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থান সীমিত করেছে, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। এইচটিএস তুলনামূলকভাবে নারীর অধিকারের ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয় নীতি গ্রহণ করেছে, যদিও এখনও তাদের নীতির দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব অস্পষ্ট।

ভবিষ্যতের দিগন্ত: সিরিয়া এবং আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ অনেক অনিশ্চয়তায় ভরপুর। এইচটিএস-এর জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো কুর্দিদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন, ইরান ও আসাদ-পন্থী গোষ্ঠীর প্রতিরোধ মোকাবেলা এবং দেশ পুনর্গঠন। অন্যদিকে, তালেবান অর্থনৈতিক সংকট, মানবিক সঙ্কট এবং আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতার মোকাবেলা করছে।

যদিও কিছু সাদৃশ্য বিদ্যমান, সিরিয়া আফগানিস্তানের পথ অনুসরণ করছে না। উভয় দেশই দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষ, শরণার্থী সংকট এবং বৈদেশিক হস্তক্ষেপের শিকার। তাদের ভবিষ্যৎ সরকারের কার্যকারিতা, আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভরশীল।

সিরিয়া কি নতুন আফগানিস্তান? বর্তমানে উত্তর ‘না’, তবে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। সময়ই বলবে কোন দিকে এই দুটি দেশ অগ্রসর হবে।

মিডলইস্টমনিটরে প্রকাশিত সাইয়েদ ইয়াকুব এমাদের  Is Syria the new Afghanistan? অবলম্বনে।