বিশ্বব্যাংকের নজরে রাষ্ট্রায়ত্ত ৪ ব্যাংক, জনতা ব্যাংকে জোর

বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সম্পদের মান যাচাই করতে আন্তর্জাতিক অডিট ফার্ম নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত জনতা ব্যাংকের ওপর বিশেষ নজর রাখা হবে। অন্যান্য তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হলো সোনালী, রূপালী এবং অগ্রণী ব্যাংক।

জনতা, সোনালী, রূপালী এবং অগ্রণী ব্যাংকের লোগো

এর আগে বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সুপারিশে দুটি আন্তর্জাতিক অডিট ফার্ম— আর্নেস্ট অ্যান্ড ইয়ং এবং কেপিএমজি— ইতিমধ্যেই ছয়টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের (ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংক) অডিট শুরু করেছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও ছয়টি ব্যাংকের অডিট হবে।

ব্যাংকগুলোর প্রকৃত আর্থিক স্বাস্থ্য উন্মোচন করতে আন্তর্জাতিক অডিট ফার্মের মাধ্যমে মূল্যায়ন করতে বিশ্বব্যাংক তীব্র আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও এই কাজের জন্য বিদেশি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট নিয়োগের পক্ষে।

তবে অর্থ মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে এ ধরনের ‘ফরেনসিক অডিট’ অনুমোদন করবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাংক চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ফরেনসিক অডিটের দাবি করেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা আলোচনার মধ্যে আছি, এ বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কার্যকলাপে, বোর্ড অব ডিরেক্টর নিয়োগ ও অপসারণসহ, সরাসরি জড়িত থাকার কারণে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ফরেনসিক অডিট অনুমোদন করতে অনিচ্ছুক বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তাদের মতে, ফরেনসিক অডিট ব্যাংকগুলোর জড়িত গুরুতর দুর্নীতি উন্মোচন করতে পারে, যা তাদের সম্পৃক্ততাকে আলোকপাত করতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ফরেনসিক অডিট রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের আর্থিক সমস্যার পূর্ণাঙ্গ চিত্র এবং সমস্যার মূল কারণ উন্মোচন করবে। এ ফলাফল শুধু বর্তমান সমস্যাগুলোই চিহ্নিত করবে না, ভবিষ্যতের বাধা প্রতিরোধেও সাহায্য করবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এই ব্যাংকগুলোর ফরেনসিক অডিট প্রত্যাখ্যান করার কোনো কারণ নেই।

তিনি উল্লেখ করেন, এই ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান এবং লিক্যুইডিটি অবনতি হয়েছে। খেলাপি ঋণ ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ‘যখন সম্পদের মান এতটাই অবনতি হয়, তখন কারণ উন্মোচনের জন্য বিশেষ অডিট অপরিহার্য,’ তিনি বলেন।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মালিক ও নিয়ন্ত্রক হিসেবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। জাহিদ হোসেন মন্তব্য করেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের জ্ঞাতসারে বা সম্মতিতে ছাড়া এই ব্যাংকগুলোতে এত ব্যাপক অনিয়ম চলতে পারে না। তাই আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এই প্রতিষ্ঠানগুলো পরীক্ষা করার জন্য বিদেশি অডিট ফার্ম নিয়োগ করতে অনিচ্ছুক হতে পারে।

জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ জুন ২০২৪ পর্যন্ত ৬০,৪৮৯ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ৬১ শতাংশ। বেক্সিমকো গ্রুপ এবং এস আলম গ্রুপের মতো বড় ঋণগ্রহীতারা ব্যাংকটি থেকে যথাক্রমে ২৪,৬৮২ কোটি এবং ১০,১০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যার বেশিরভাগই এখন খেলাপি।

অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অবস্থাও উদ্বেগজনক। অগ্রণী ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ সেপ্টেম্বর ২০২৪-এ ২৬,৮৯১ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এর মধ্যে শীর্ষ দশ ঋণখেলাপির ঋণের পরিমাণ মোট খেলাপির ৩০.৯৫ শতাংশ। রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সেপ্টেম্বর ২০২৪-এর শেষে ১২,৭৩৮ কোটি টাকা এবং সোনালী ব্যাংকের ১৬,৬২৩ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।

৫ আগস্ট, ২০২৪-এ গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংকিং খাত থেকে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ উত্তোলন করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করে এস আলম গ্রুপ এবং অন্যান্য রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর প্রভাব কমিয়েছে।