অর্থনীতি সংক্রান্ত সদ্য প্রকাশিত শ্বেতপত্রে দাবি করা হয়েছে, দেশের ১০টি ব্যাংক ‘কার্যত দেউলিয়া’ এবং ‘অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল’। আজ রোববার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের তেজগাঁও কার্যালয়ে এ সংক্রান্ত একটি কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কমিটির সদস্যরা শেখ হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতি, লুণ্ঠন এবং পরিসংখ্যানগত কারসাজির মাত্রা দেখে হতবাক হয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

bank robberyপ্রতীকী ছবি

শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, ১০টি সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকের সচ্ছলতা ও তারল্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, যারা বিগত দশকে বড় ধরনের কেলেঙ্কারির মুখোমুখি হয়েছে। বাকি আটটি ইসলামী ও প্রচলিত বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক।

যদিও শ্বেতপত্রে ব্যাংকগুলোর নাম প্রকাশ করা হয়নি, তবে দাবি করা হয়েছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, গণমাধ্যম এবং জনসাধারণ এই ১০টি ব্যাংককেই সমস্যাগ্রস্ত বলে চিহ্নিত করে। এই ১০টি ব্যাংকের মোট ঋণ ও আমানত ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের ৩৩ শতাংশ এবং মোট আমানতের ৩২ শতাংশ।

শ্বেতপত্র অনুযায়ী, অধিকাংশ ব্যাংকই তাদের আর্থিক প্রতিবেদনে সম্পদের প্রকৃত মূল্য প্রকাশ করেনি। তাদের সম্পদের প্রকৃত মূল্য প্রতিবেদন অনুযায়ী মূল্যের মাত্র ৫২ শতাংশ। ফলে, তাদের মোট সম্পত্তির মূল্য ঋণাত্মক। বাস্তব সম্পদের তুলনায় তরল সম্পদের অনুপাত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১০টির মধ্যে ৮টি ব্যাংকই তারল্য সংকটে রয়েছে।

শ্বেতপত্রে আরও উঠে এসেছে, শেখ হাসিনার ‘দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরাচারী’ শাসনামলে প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার অবৈধভাবে দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে। জনবিদ্রোহের মুখে পলায়নের সময় দেশটিকে ‘লুণ্ঠনের জগতে’ ফেলে রেখে গেছেন বলেও দাবি করা হয়েছে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও কমিটির সভাপতি ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রধান উপদেষ্টার তেজগাঁও কার্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনটি জমা দিয়েছেন। গত ২১ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়।

শ্বেতপত্রে যেসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো: সরকারি অর্থ ব্যবস্থাপনা – অভ্যন্তরীণ সম্পদ, সরকারি ব্যয় (সরকারি বিনিয়োগ, এডিপি, ভর্তুকি এবং ঋণ), বাজেট ঘাটতির অর্থায়ন; মুদ্রাস্ফীতি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা - উৎপাদন, সরকারি ক্রয় ও সরকারি খাদ্য বিতরণ; বৈদেশিক ভারসাম্য - রপ্তানি, আমদানি, রেমিট্যান্স, এফডিআই, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বৈদেশিক অর্থ প্রবাহ এবং ঋণ; জ্বালানি ও বিদ্যুৎ - চাহিদা, সরবরাহ, মূল্য নির্ধারণ, খরচ এবং ক্রয় চুক্তি; বেসরকারি বিনিয়োগ - ঋণ, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং পরিবহনের সুবিধা; কর্মসংস্থান - দেশীয় এবং বিদেশি, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক মজুরি, যুব কর্মসংস্থান।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস কমিটিকে এই যুগান্তকারী কাজের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এটি চূড়ান্ত হওয়ার পর প্রকাশ করা উচিত এবং জাতীয় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

শ্বেতপত্র গ্রহণের পূর্বে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। এটি আমাদের দেখাবে জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনের পর আমরা কেমন অর্থনীতি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। এই দলিল থেকে জাতি উপকৃত হবে।’

‘তারা কিভাবে অর্থনীতিকে লুণ্ঠন করেছে তা জানতে আমাদের রক্ত জমাট বাঁধছে। দুঃখের বিষয় হলো তারা প্রকাশ্যে অর্থনীতিকে লুট করেছে। আর আমাদের অধিকাংশই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস জোগাতে পারেনি,’ তিনি বলেন।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি পর্যবেক্ষণকারী বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলিও এই লুণ্ঠনের সময় মূলত নীরব ছিল।

কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, তারা সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে কাজ করেছেন।

‘সমস্যা আমরা যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও গভীর,’ তিনি বলেন। তিনি আরও জানান, ৩০ অধ্যায় এবং ৪০০ পৃষ্ঠার এই শ্বেতপত্র দেখাবে কিভাবে ক্রনি পুঁজিবাদ অলিগার্কদের জন্ম দিয়েছে, যারা নীতিমালা প্রণয়ন নিয়ন্ত্রণ করত।

কমিটির সদস্য মুস্তাফিজুর রহমান জানান, ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের ২৯টি প্রকল্পের মধ্যে তারা সাতটি বৃহৎ প্রকল্প পরীক্ষা করেছেন। ২৯টি বৃহৎ প্রকল্পের মোট ব্যয় ছিল ৮৭ বিলিয়ন ডলার বা ৭,৮০,০০০ কোটি টাকা।

পরীক্ষিত সাতটি প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ১,১৪,০০০ কোটি টাকা। পরবর্তীতে অনেক উপাদান যোগ করে, জমির দাম বাড়িয়ে এবং ক্রয়ে কারসাজি করে প্রকল্পের ব্যয় ১,৯৫,০০০ কোটি টাকায় সংশোধন করা হয়।

তিনি বলেন, ব্যয়-সুবিধা বিশ্লেষণ না করেই প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৭০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।

তিনি মানি লন্ডারিংয়ে জড়িতদের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পরামর্শও দেন।

কমিটির সদস্য অধ্যাপক এ কে এনামুল হক বলেন, গত ১৫ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ৭০০,০০০ কোটি টাকারও বেশি ব্যয় করা হয়েছে এবং এর ৪০ শতাংশ চুরি করেছেন আমলারা।

কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আবু ইউসুফ জানান, গত শাসনামলে মোট জিডিপির ছয় শতাংশ ছিল কর অব্যাহতির পরিমাণ।

তিনি বলেন, এটি অর্ধেকে নামিয়ে আনা গেলে শিক্ষা বাজেট দ্বিগুণ এবং স্বাস্থ্য বাজেট তিনগুণ করা যেত।

কমিটির আরেক সদস্য এম তামিম জানান, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং যদি ১০ শতাংশ ঘুষ ধরা হয়, তাহলে এর পরিমাণ কমপক্ষে ৩ বিলিয়ন ডলার হবে।

অনুষ্ঠানে অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, প্রধান সচিব সিরাজউদ্দিন সাথী এবং সিনিয়র সচিব লামিয়া মোর্শেদ উপস্থিত ছিলেন।

ডেইলি স্টার অবলম্বনে

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.