ব্যালন ডি’অর বিতর্ক: বর্ষসেরা রদ্রি

ফুটবল দুনিয়াকে চমকে দিতে এই তথ্যটাই যথেষ্ট ছিল। ব্যালন ডি’অর জিতছেন না ভিনিচিয়াস জুনিয়র। তাহলে কে জিতবেন ফ্রান্স ফুটবল সাময়িকীর বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের মুকুট? এই প্রশ্নের উত্তটা তখন সহজ হয়ে গিয়েছিল। এ বছর ছেলেদের ব্যালন ডি’অরের খেতাব উঠল ম্যানচেস্টার সিটির স্প্যানিশ মিডফিল্ডার রদ্রির হাতে। ৬৪ বছর পর স্পেনের কেউ জিতলেন এই খেতাব।

স্বপ্নের ব্যালন ডি’অর ট্রফিতে চুমু আঁকছেন ম্যানচেস্টার সিটির স্প্যানিশ মিডফিল্ডার রদ্রি। ছবি: রয়টার্স

সোমবার রাতে প্যারিসে জমকালো আয়োজনের মধ্য দিয়ে রদ্রির হাতে তুলে দেওয়া হয় ব্যালন ডি’অর। ওই মাহেন্দ্রক্ষণ শুরুর আগেই বিশ্বজুড়ে বয়ে গেল আলোচনা ও সমালোচনার ঝড়। আবারও বিতর্কিত হয়ে উঠল ফরাসি ম্যাগাজিনের সেরা খেলোয়াড় বাছাইয়ের প্রক্রিয়া। এই ইস্যুতে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল ফুটবল বিশ্ব।

যার বড় একটা অংশের ধারণা ছিল ১৭ বছর পর কোনো ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারের হাতে উঠবে ব্যালন ডি’অর। গত কয়েক সপ্তাহজুড়ে বিশ্বের নামিদামী সংবাদমাধ্যমগুলোও এমন খবর ঢালাওভাবে প্রকাশ করে এসেছে। কিন্তু অনুষ্ঠান শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে বিস্ফোরক খবরটা এলো। শেষ মুহূর্তে উল্টে গেল পাশার দান। ব্যালন ডি’অর জয়ী হিসেবে রদ্রির নাম ঘোষণা করেন লাইবেরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট, এসি মিলান কিংবদন্তি ও ১৯৯৫ সালের ব্যালন ডি’অরজয়ী জর্জ উইয়াহ।

এমন খবর আগেই টের পেয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ। এর প্রতিক্রিয়াও সঙ্গে সঙ্গে দেখিয়েছে স্প্যানিশ ক্লাবটি। রিয়ালের তরফ থেকে ৫০ জনের একটি বহর প্যারিসের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার যে পরিকল্পনা ছিল সেটি বাতিল হয়ে গেল মুহূর্তেই। ক্লাব সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বাতিল করলেন প্যারিস যাত্রা।

কেবল ভিনি ব্যালন ডি’অর না পেলেও বর্ষসেরা কোচ হয়েছেন তার গুরু কার্লো আনচেলত্তি। ম্যানচেস্টার সিটির পেপ গার্দিওলা, বায়ার লেভারকুজেনের জাবি আলোনসো ও স্পেনের লুইস দে লা ফুয়েন্তেকে সেরার লড়াইয়ে হারিয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদ কোচ। কিন্তু ভিনি বর্ষসেরা না হওয়ায় নিজেরও পুরস্কারও আনতে যাননি ইতালিয়ান কোচ।

গত মৌসুমে গুরু-শিষ্যের রসায়নের ওপর দাঁড়িয়ে রিয়াল জিতেছিল উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ, স্প্যানিশ লা লিগা ও স্প্যানিশ সুপার কাপ। বর্ষসেরা নারী কোচ হয়েছেন চেলসির সাবেক ও যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ইংলিশ কোচ এমা হায়েস। আর মেয়েদের বর্ষসেরার পুরস্কার টানা চতুর্থবার গেল বার্সেলোনায়। টানা দ্বিতীয়বার এটা জিতলেন আইতানা বোনমাতি।

দীর্ঘ ২১ বছর পর ব্যালন ডি’অরের প্রাথমিক তালিকায় মনোনয়ন পাননি লিওনেল মেসি কিংবা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। এই দুজন মিলেই বর্ষসেরা হয়েছেন ১৩বার। মেসি সর্বোচ্চ আটবার; রোনালদো পাঁচবার। গত দেড় দশকে তাদের বাইরে সেরা হয়েছেন কেবল দুজন। দুজনই রিয়াল মাদ্রিদের। একজন লুকা মডরিচ অন্যজন করিম বেনজেমা। এই দুজনের কেউ এবার ছিলেন না সেরার লড়াইয়ে।

তাতেই নিশ্চিত হয়ে যায় ব্যালন ডি’অরে আসছে নতুন মুখ। সম্ভাব্য নতুন মুখ হিসেবে ভিনিকেই এগিয়ে রাখা হয়েছিল। ক্লাব ফুটবলে গত মৌসুম শেষে তো ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকারের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিই ছিল না। বিপত্তি বাধল গিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে। ভিনির ব্রাজিল কোপা আমেরিকার কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেয়। যা ব্যালন ডি’অরের লড়াইয়ে ফেরায় অন্যদের।

এই সুযোগটাই নিয়েছেন রদ্রি। স্পেনের হয়ে তিনি স্বাদ পান ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের। সঙ্গে ক্লাব ফুটবলে ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে ইংলিশ লিগ শিরোপা। তবু ভিনিকে পেছনে ফেলার মতো অবস্থান তিনি তৈরি করতে পেরেছেন কিনা এ নিয়ে সংশয়ের কারণ থাকল যথেষ্ট। ব্যালন ডি’অর যে এখন প্রহসনের পুরস্কার হয়ে উঠেছে বিশ্বজুড়ে এমন সমালোচনাও বেশ সরব হয়েছে।

একটা সময় রোনালদো নিজেও বলেছিলেন, ‘ব্যালন ডি’অর তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।’ গত বছর মেসি আহামরি ‘কিছু’ না করেই যখন বর্ষসেরা হয়েছিলেন তখন উঠেছিল সেই বিতর্ক। যা নতুন করে এবার ফিরে এলো রদ্রি বর্ষসেরা হওয়ায়। কিন্তু তারচেয়েও তো বেশি দলীয় সাফল্য ছিল আরও দুজনের। একজন রদ্রিরই জাতীয় দলের সতীর্থ ড্যানি কারভাহাল। অন্যজন ইন্টার মিলানের আর্জেন্টাইন ফরওয়ার্ড লাওতারো মার্টিনেজ।

কারাভাহাল রিয়ালের জার্সিতে জিতেছেন তিনটি ট্রফি। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে করেছেন গোল। পরে স্পেনের হয়ে স্বাদ পান ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের। দলীয় সাফল্যে পিছিয়ে রাখা কঠিন ছিল মার্টিনেজকেও। ইন্টার মিলানের সিরি’এ লিগ জয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার। আর্জেন্টিনার কোপা আমেরিকা জয়েও অবদান রেখেছেন। দুই প্রতিযোগিতাতেই মার্টিনেজ ছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা।

ফেভারিট না হলেও, ব্যালন ডি’অরের লড়াইয়ে ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের আরও দুই ফুটবলার কিলিয়ান এমবাপ্পে ও জুডে বেলিংহাম। এমবাপ্পে প্যারিস সেন্ট জার্মেইর (পিএসজি) হয়ে পেয়েছেন দ্বিমুকুটের স্বাদ। কিন্তু জাতীয় দল ফ্রান্সের জার্সিতে ছিলেন অচেনা। বেলিংহাম রিয়ালে সাফল্য পেয়েছেন। ইংল্যান্ডের হয়ে আলো ছড়িয়েছেন। ইংলিশরা যে ইউরোর ফাইনালে উঠেছিল সেখানে বেলিংহামের ছিল প্রত্যক্ষ অবদান।

ভিনি অ্যান্ড কোং অনুষ্ঠানে না আসায় রদ্রির দিকেই ছিল পুরো আকর্ষণ। গালায় প্রবেশ করতেই সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে গেলেন তিনি। অবধারিতভাবেই ব্যালন ডি’অর নিয়ে বিতর্ক প্রশ্ন উঠল। উত্তরে রদ্রি বলেছেন, ‘আমি কিছু জানি না। দেখা যাক কী হয়।’ রদ্রির কথাতে বোঝা যাচ্ছে, তিনি যে সেরা ফুটবলার হতে যাচ্ছেন সেটা জানেনই না! কিন্তু ভিনি জানতেন তিনিই বর্ষসেরা হবেন।

এই তো গেল শনিবার এল ক্লাসিকো চলাকালীন বার্সেলোনার এক ফুটবলারকে মাঠে ব্রাজিলিয়ান তারকা বলছিলেন, ‘আমি সোমবার যাচ্ছি, ব্যালন ডি’অর জিততে।’ ভিনি স্বপ্নযাত্রায় বড়সড় একটা হোঁচট খেলেন। যা রিয়াল মাদ্রিদের কাছে মহাবিস্ময়ের। পেরেজের সিদ্ধান্তে অনুষ্ঠান বয়কট করেছে রিয়াল মাদ্রিদ। যেটা ফুটবলের জন্য অমঙ্গল দেখছেন স্পেনের ইউরোজয়ী কোচ লা ফুয়েন্তে।

সংবাদমাধ্যমকে সফল এই কোচ বলেছেন, ‘এটা ফুটবলের জন্য ভালো হলো না। রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাব এই গালায় নেই, এটা ভালোকিছুর বার্তা দিচ্ছে না।’ শুধু অনুষ্ঠানে অনুপস্থিতিই নয়, রিয়ালের যত সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আছে সব জায়গা থেকেই এই আয়োজন বয়কটের ঘোষণা দিয়েছে বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্লাবটি।