ব্যাংকিং খাতে তীব্র আস্থার সঙ্কট, সংস্কারে ধীরগতি!

দেশের ব্যাংকিং খাতে তীব্র আস্থার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষেত্রটিতে চলমান সাংগঠনিক দুর্বলতা, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে ও সমস্যার কার্যকর সমাধানে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংক

বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার মতে, গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সীমিত পরিসরে পুনর্গঠনের বাইরে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ সংস্কার কাজ শুরু হয়নি।

শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং ৫ আগস্ট ভারতে চলে যাওয়ার পর ব্যাংকিং খাত স্থিতিশীল হবে বলে প্রাথমিকভাবে আশা করা হলেও, বাস্তবতা হলো পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।

বহু ব্যাংক এখনও আমানতকারীদের চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে, যার ফলে জনসাধারণের মধ্যে আস্থার সঙ্কট তীব্রতর হচ্ছে এবং আতঙ্কিত হয়ে আমানতকারীরা টাকা তুলে নিচ্ছেন।

গত ৮ সেপ্টেম্বর নতুন গভর্নর আব্দুল এইচ মনসুর স্বীকার করেছেন যে, প্রায় ১০টি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তার এই বক্তব্য গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দেয় এবং আমানত তোলার হিড়িক তীব্রতর করে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন এবং সরাসরি তরলতা সহায়তা না দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।

এসব পদক্ষেপ আমানতকারীদের মধ্যে অবিশ্বাস আরও বাড়িয়ে দিয়েছে এবং সমস্যায় জর্জরিত ব্যাংকগুলোর জন্য ঘুরে দাঁড়ানো আরও কঠিন করে তুলেছে।

সঙ্কট মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সীমিত পরিসরে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। আন্তঃব্যাংক ঋণের জামানত প্রদান এবং বিগত এক মাসে ৬টি সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকে ৫,০০০ কোটি টাকা সরবরাহ করা হয়েছে।

তবে ব্যাংকিং খাতের তরলতা সংকট এখনও কাটেনি। আমানতকারীরা তাদের জমানো টাকার নিরাপত্তা নিয়ে এখনও উদ্বিগ্ন।

ব্যাংকিং খাতে সঙ্কট কাটছে না

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেছেন, বর্তমানে প্রায় ১৫টি ব্যাংক বিভিন্ন সংকটের মুখোমুখি যা শিগগিরই সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা কম।

তিনি আরও বলেন, কিছু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের বাইরে এখনো তেমন কোনো তাৎপর্যপূর্ণ সংস্কার লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। আমরা আশা করছি চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে কিছু দৃশ্যমান সংস্কার দেখা যাবে।’

মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হলেও, পূর্বের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা একই পদে বহাল রয়েছেন, যা অর্থবহ পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে তাদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

তিনি স্বীকার করেছেন যে বহু বছর ধরে কর্মরত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতিস্থাপন করা একটি চ্যালেঞ্জ।

আমানতকারীদের মধ্যে আস্থার সঙ্কটের বিষয়ে মাহবুবুর রহমান বলেন, এক-চতুর্থাংশ ব্যাংক তীব্র তরলতা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।

এছাড়াও, তিনি ব্যাংকিং খাতের চলমান সঙ্কটের পেছনে সার্বিক অনিশ্চয়তা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কথাও উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যাংকারসহ সরকারি কর্মকর্তারা ‘অপেক্ষা করো এবং দেখো’ নীতিতে বিশ্বাসী।’

আগস্টের শেষ কর্মদিবস পর্যন্ত ব্যাংকগুলোতে মোট আমানত কমে ১৭.৩১ লাখ কোটি টাকায় নেমে এসেছে, যা জুলাই মাসের শেষ কর্মদিবসে ছিল ১৭.৩৪ লাখ কোটি টাকা।

আগস্টের শেষে, জনসাধারণের হাতে থাকা মুদ্রার পরিমাণ টানা দশম মাসের জন্য বেড়ে ২.৯২ লাখ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, কারণ আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে রাখছেন।

জুন মাস নাগাদ খেলাপি ঋণ বেড়ে ২.১১ লাখ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৮৮,৭৩৪ কোটি টাকা। এটি ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলা ঋণ বিতরণে অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে।

এস আলম গ্রুপ কিছু ব্যাংক এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সাজানো প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা ঋণ উত্তোলন করেছে।

একইভাবে, বেক্সিমকো গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে ২৫,০০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে যার মধ্যে ১৮,০০০ কোটি টাকা এখন খেলাপি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ধরনের ব্যাপক ঋণ অনিয়মের প্রতি অনেকটা নীরব ভূমিকা পালন করে করেছে। নিয়মকানুন শিথিল এবং নীরবতা পালন করে তারা এসব গোষ্ঠীকে সহায়তা করেছে।

ফলস্বরূপ, ব্যাংকিং খাত তীব্র তরলতা সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে এবং আমানতকারীরা শুধুমাত্র কিছু ব্যাংকের প্রতি নয়, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর প্রতিও আস্থা হারাচ্ছেন।

ব্যাংকারদের মতে, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এমন ক্ষমতাধর কর্মকর্তারা তাদের পদে বহাল রয়েছেন, যার ফলে অর্থবহ সংস্কার প্রচেষ্টা ব্যাহত হচ্ছে।

এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যেও এস আলম এবং বসুন্ধরার মতো গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা তাদের পদে বহাল রয়েছেন, যার ফলে দুর্নীতি রোধে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যর্থ হচ্ছে বলে তারা মনে করেন।

এখন পর্যন্ত, বাংলাদেশ ব্যাংক এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত রয়েছে, যার ফলে জবাবদিহিতার অভাব তৈরি হচ্ছে এবং ব্যাংকিং খাতের চলমান সঙ্কট আরও ঘনীভূত হচ্ছে।

এছাড়াও, ডলার সংকট, বিনিময় হার বৃদ্ধি, তীব্র তরলতা সংকট এবং উচ্চ সুদের হার ব্যবসায়ীদের ঋণ গ্রহণ এবং ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে, যা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

এই করুণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে সরকারও ব্যাংকিং খাত থেকে পর্যাপ্ত ঋণ সুরক্ষিত করতে সংগ্রাম করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা বলেন, জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার এবং সুশাসন নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে।

ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পূর্বের অনিয়েমের তথ্য গোপন করার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, জনস্বার্থে ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ যেকোনো কর্মচারীকে অপসারণ, বদলি বা প্রতিস্থাপনের ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের।

তিনি আরও বলেন, সংশ্লিষ্ট বোর্ডের সুপারিশের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক বলেন, কোনো ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা গ্রহণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

নিউএজ থেকে অনূদিত