গাজার যুদ্ধের ক্ষত ইসরায়েলি সেনাদের বুকেও!

গাজায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা ইসরায়েলি হামলায় সর্বস্বান্ত হয়েছে সেখানকার বাসিন্দারা। স্বজন, আশ্রয়, খাবার, নিরাপত্তা—সবকিছুই হারিয়েছেন তারা। কিন্তু যাদের হামলায় তাদের এই অবস্থা, সেই ইসরায়েলি সেনারাও ভালো নেই। গাজায় চালানো নৃশংসতার প্রত্যক্ষদর্শী এই সেনাদের অনেকেই এখন ট্রামায় ভুগছেন। আত্মহত্যার হার বেড়ে গেছে সেনাবাহিনীতে।

গাজায় আহত সেনাকে ফেরত নেওয়া হচ্ছে

এলিরান মিজরাহি ইসরায়েলে একটি নির্মাণ কোম্পানিতে বুলডোজার চালাতেন। গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। গাজায় তাকে দেওয়া হয় ডি-৯ মডেলের একটি বুলডোজার চালানোর দায়িত্ব। ৬২ হাজার কেজি ওজনের এই বুলডোজার গুলি ও বোমা হামলার মুখেও টিকে থাকতে সক্ষম।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তার বুলডোজারে হামলা হলে আহত হন এলিরান। চিকিৎসার জন্য তাকে ইসরায়েলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু এরপরই দেখা দেয় মানসিক সমস্যা। এপ্রিল থেকে তাকে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের (পিটিএসডি) চিকিৎসা দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু কোনো কাজেই আসেনি চিকিৎসা। অল্পতেই রেগে যেতেন তিনি। রাতের পর রাত ঘুমাতে পারতেন না। স্বজনদের বলতেন, ‘গাজায় আমি যে কী অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছি, তা কেবল সেখানে থাকা লোকজনই বুঝবে।’

অবশেষে আত্মহত্যা করেন এলিরান। তার মা জেনি মিজরাহি বলেন, ‘আমার ছেলে গাজা ছেড়েছিল, কিন্তু গাজা তাকে ছাড়েনি। সেই অবসাদেই এক সময় আমাদের ছেড়ে চলে গেল।’

এলিরানের সঙ্গে গাজায় বুলডোজার চালাতেন তার বন্ধু গুই জাকেন। তার কানে এখন সব সময় বিস্ফোরণের শব্দ বাজতে থাকে। ঘুমানোর জন্য সংগ্রাম করতে হয়। মাংস খেতে পারেন না। কারণ সে সময় গাজায় বুলডোজারের ভেতর থেকে দেখা নানা দৃশ্যের কথা মনে পড়ে যায় তার।

শুধু এলিরান বা গুই জাকেন নয়, গাজাফেরত বা গাজায় কর্মরত হাজার হাজার ইসরায়েলি সেনার মধ্যেই এখন পিটিএসডি-সহ নানা ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। গাজার নৃশংসতা, বর্বরোচিত হামলার দৃশ্য, অসংখ্য মৃত্যু—এসব মিলিয়ে তারা এখন চরম মানসিক চাপের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন।

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) একজন চিকিৎসক বলেন, ‘গাজা থেকে ফিরে আসা অনেক সেনাই এখন আতঙ্কে ভুগছেন। তারা মনে করছেন, তাদেরকে আবার লেবাননে পাঠানো হতে পারে। গাজায় লড়াই করা ইসরায়েলি সেনারা জানান, গাজা উপত্যকায় তারা যে ভয়াবহতা দেখেছেন, তা বাইরের মানুষ কল্পনাও করতে পারবেন না।’

যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজ লন্ডনের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আহরন বার্গম্যান বিভিন্ন যুদ্ধে ইসরায়েলি বাহিনীর হয়ে কাজ করেছেন। তার মতে, ‘এবারের যুদ্ধগুলো ইসরায়েলের আগের যুদ্ধের চেয়ে ভিন্ন। ইসরায়েলি বাহিনী এখন শহর এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ করছে। তাদেরকে লড়তে হচ্ছে বেসামরিক লোকদের বিরুদ্ধেও। তারা অসংখ্য মৃত মানুষ দেখছেন। ধ্বংসস্তূপের সঙ্গে মরদেহগুলোর ওপর দিয়েই তাদের চলতে হচ্ছে। আর এসবই তাদের মানসিক অবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।’

বার্গম্যান আরও বলেন, ‘গাজায় অসংখ্য বেসামরিক নারী ও শিশু নিহত হতে দেখার পর কীভাবে আপনি নিজের সন্তানদের ঘুম পাড়াবেন?’

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রতি মাসে এক হাজারের বেশি আহত সেনাসদস্য চিকিৎসার জন্য ফিরে আসছেন। তাদের ৩৫ শতাংশই মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। চলতি বছরের শেষ নাগাদ ১৪ হাজার সেনাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হতে পারে। তাদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সিএনএনের প্রতিবেদন অবলম্বনে