জামায়াতের ৪১ দফা সংস্কার প্রস্তাব: বিচারব্যবস্থা, ইভিএম বাতিলসহ ব্যাপক পরিবর্তনের আহ্বান

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রীয় সংস্কারের জন্য ৪১ দফা সমন্বিত প্রস্তাবনা পেশ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে বিচার বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) বিলুপ্তি এবং পুলিশ আইনে সংস্কার। দলটি সরকারি চাকরিতে প্রবেশে বয়সসীমা ৩৫ বছর এবং অবসরের বয়স ৬২ বছরে উন্নীত করারও দাবি জানিয়েছে।

বাংলাদেশ জামায়তে ইসলামীর লোগো

বুধবার রাজধানীর গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের নায়েবে আমীর ড. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এসব প্রস্তাব তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে জামায়াতের আমীর ড. শফিকুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন।

নিজ বক্তব্যের শুরুতে ড. তাহের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নিহতদের জন্য দোয়া করেন এবং আল্লাহর কাছে তাদেরকে শহীদ হিসেবে কবুল করার আহ্বান করেন। তিনি আওয়ামী লীগকে দেশে স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অভিযুক্ত করে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ প্রশাসন, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ দখল করে স্বৈরাচারের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছে। নির্যাতনের রাজত্ব সৃষ্টি করতে হাজার হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে।’

বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের মধ্যে পৃথকীকরণের ওপর জোর দিয়ে ড. তাহের বলেন, ‘ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিচার বিভাগের সংস্কার অপরিহার্য।’

তিনি আরও বলেন, দেওয়ানি মামলা পাঁচ বছরের মধ্যে এবং ফৌজদারি মামলা তিন বছরের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তন এবং ইভিএম বিলুপ্তি

জাতীয় নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবি জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটি অভিযোগ করে যে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রক্রিয়া ধ্বংস করে দিয়েছে।

‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে,’ দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়। স্থায়ীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তন এবং ইভিএম ব্যবস্থা বাতিলের ওপর জোর দেওয়া হয়।

পুলিশ সংস্কার এবং জবাবদিহিতা

পুলিশ আইনে সংস্কারেরও দাবি জানায় জামায়াত। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধে বদলি ও পদোন্নতির জন্য স্বাধীন কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়।

ড. তাহের পুলিশ প্রশিক্ষণে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার এবং প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার কমানোর পক্ষে মত দেন।

সরকারি চাকরিতে সংস্কার

সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে জামায়াতের প্রস্তাব, চাকরির আবেদনপত্র বিনামূল্যে করা এবং সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা আগামী দুই বছরের জন্য ৩৫ বছর করা এবং পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে ৩৩ বছর নির্ধারণ করা। অবসরের বয়স ৬২ বছর করারও প্রস্তাব করা হয়।

এছাড়াও প্রশ্নপত্র ফাঁস অথবা দুর্নীতির মাধ্যমে প্রাপ্ত নিয়োগ বাতিলেরও দাবি জানানো হয়। দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য শক্তিশালী করার ওপরও জোর দেওয়া হয়।

প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের সীমা

প্রধানমন্ত্রী পদে দুই মেয়াদের সীমা নির্ধারণের প্রস্তাব করে জামায়াত। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার পক্ষে মত দেয় দলটি।

সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত সংস্কার

শিক্ষা ও সংস্কৃতি খাতেও সংস্কারের প্রস্তাব করে জামায়াত। সকল স্তরের শিক্ষায় হযরত মুহাম্মদের (সা.) এর জীবনী ও শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়। এছাড়াও চলচ্চিত্র, টেলিভিশন নাটক এবং ডিজিটাল কন্টেন্টে অশ্লীলতা দূরীকরণের আহ্বান জানানো হয়।

পররাষ্ট্রনীতি এবং হজ ব্যয়

ড. তাহের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রতিবেশী দেশগুলোর, বিশেষ করে চীন, নেপাল এবং ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীর পানি বন্টনের ক্ষেত্রে ন্যায্য ও ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের গুরুত্বারোপ করেন। হজ ও ওমরাহ তীর্থযাত্রীদের জন্য খরচ কমাতে সরকারের প্রতি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ারও আহ্বান জানায় জামায়াত।

নির্যাতনের বিচার

জামায়াত আমীর ড. শফিকুর রহমান দাবি করেন, যারা গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল এবং দেশ ছেড়ে পালিয়েছে তাদের ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হোক।

নির্বাচন বনাম সংস্কার: জামায়াতের রোডম্যাপ

নির্বাচন ও সংস্কারের ধারাবাহিকতা সম্পর্কে জানতে চাইলে ড. শফিকুর রহমান বলেন, সংস্কার ও নির্বাচনের জন্য দুটি পৃথক রোডম্যাপ থাকবে।

তিনি আরও বলেন, কোনও প্রক্রিয়াই অত্যন্ত দীর্ঘ বা তাড়াহুড়ো করে করা উচিত নয়। দেশে অনেক রাজনৈতিক দল রয়েছে। একটি জীবন্ত সংসদের জন্য, জনগণকে শুধু দল নয়, সঠিক প্রার্থীর পক্ষে ভোট দিতে হবে।