বিশ্বকে নতুন বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার আহ্বান

শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার প্রথম ভাষণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন, যেখানে সবার জন্য স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস

বাংলায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে নোবেল শান্তি পুরষ্কারপ্রাপ্ত এই ব্যক্তিত্ব বলেন, বাংলাদেশের তরুণরা দেখিয়েছে যে, ব্যক্তির পার্থক্য ও মর্যাদা নির্বিশেষে সবার স্বাধীনতা, মর্যাদা এবং অধিকার রক্ষা করা শুধু আকাঙ্ক্ষা নয়, এটা প্রত্যেকেরই প্রাপ্য অধিকার। তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সমতা এবং সমৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে এবং আরও গভীর করতে, যাতে বাংলাদেশ একটি ন্যায়বিচার ও সমন্বিত গণতান্ত্রিক সমাজ হিসেবে উঠে আসতে পারে।

ইউনূস উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে কর্মসংস্থান, সামাজিক-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং জীবিকার জন্য রূপান্তরমূলক সমাধান আনার ওপর জোর দেন। তিনি নতুন ধরনের সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন যেখানে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা এবং জ্ঞান মানুষের চাহিদার সঙ্গে যুক্ত হবে।

জাতিসংঘের এই অধিবেশনে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ে সবার জন্য শান্তি, সমৃদ্ধি এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন অব্যাহত রাখার আশ্বাস দিয়েছে।

ড. ইউনূস বলেন, বিশ্বের কাছে যথেষ্ট ক্ষমতা, সম্পদ এবং সমাধান রয়েছে। জাতীয় বা আন্তর্জাতিকভাবে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করে এবং সামাজিক ব্যবসার ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে সকল ধরনের বৈষম্যের অবসান ঘটাতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান।

ইউনূস জুলাই-আগস্টের যুগান্তকারী পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করে বলেন, সাধারণ মানুষের শক্তি, বিশেষ করে তরুণদের ‘জেনারেশন জেড’ এর শক্তি জাতিকে অনেক ব্যবস্থা এবং প্রতিষ্ঠান সংস্কারের সুযোগ দিয়েছে। এই আন্দোলন প্রাথমিকভাবে বৈষম্যের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে শুরু হলেও পরবর্তীতে এটি একটি গণআন্দোলনে পরিণত হয় যেখানে স্বৈরাচার, নির্যাতন, বৈষম্য, অন্যায় এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে।

তিনি বলেন, জনগণ, বিশেষ করে তরুণরা, তাদের সংকল্প এবং ক্ষমতার মাধ্যমে একটি স্বৈরাচারী এবং অগণতান্ত্রিক শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এই ঐক্যবদ্ধ সংকল্প ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে সংজ্ঞায়িত করবে এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ে বাংলাদেশকে একটি প্রতিক্রিয়াশীল এবং দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, তরুণদের প্রজ্ঞা, সাহস এবং দৃঢ় বিশ্বাস তাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছে। শত শত মানুষ তাদের চোখ হারিয়েছে। মা, দিনমজুর এবং নগরীর অসংখ্য মানুষ ‘তাদের সন্তানদের জন্য’ তাদের কাঁধ দিয়েছে। গণআন্দোলনে স্বৈরাচারী শাসনের হাতে প্রায় আটশোরও বেশি শহীদ হয়েছে।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে তার জনগণের উদারনৈতিকতা, বহুত্ববাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি গভীর বিশ্বাসের কারণে। ‘জেনারেশন জেড’ ১৯৭১ এবং ১৯৫২ সালের মূল্যবোধগুলোকে পুনর্চিন্তা করতে বাধ্য করেছে।

তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার সকল ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ও কাজ করছে এবং বাংলাদেশ যে সকল আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক এবং দ্বিপাক্ষিক চুক্তির সঙ্গে যুক্ত সেগুলি মেনে চলবে। জাতিসংঘকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকতার একজন সক্রিয় সমর্থক হিসেবে থাকবে।

মাত্র সাত সপ্তাহে, সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে, যার মধ্যে রয়েছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্তের জন্য জাতিসংঘের মিশন প্রেরণ, জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর, নির্বাচন ব্যবস্থা, সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য স্বাধীন কমিশন গঠন, সংবাদপত্র এবং মিডিয়া সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সংস্কার কমিশন গঠন, এবং ব্যাংকিং ও আর্থিক ক্ষেত্রে সংস্কার।

তিনি আশ্বস্ত করেন যে কোনো বিদেশি ব্যবসায়িক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেওয়া হবে না এবং এই সংস্কারগুলি টেকসই করা এবং স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কার্যকর নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে।