সরকার পরিবর্তন হলেও জনশক্তি রপ্তানিকারক এজেন্সিগুলোর বেপরোয়া অর্থ আদায়ের দৌরাত্ম্য এখনও অব্যাহত রয়েছে। ফলে বিদেশগামী কর্মীরা পূর্বের মতোই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছেন। গত ৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর ৮ আগস্ট যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এসেছে, সংশ্লিষ্ট মহলের বারবার আহ্বান সত্ত্বেও রিক্রুটারদের লাগাম টেনে অভিবাসন খরচ যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে নিয়ে আসতে তারা ব্যর্থ হয়েছে।

manpower bangladeshছবি - সংগৃহীত

অভিবাসন খাতের অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে, অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসন খরচ অভিবাসীদের জন্য নানাবিধ ঝুঁকি তৈরি করছে। এতে অভিবাসীরা অর্থনৈতিক ও শারীরিকভাবে ঝুঁকির মুখে পড়ছেন, এবং বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।

ছাত্র আন্দোলনের পরও জনশক্তি রিক্রুটিং এজেন্টদের সিন্ডিকেট আগের মতোই সক্রিয় রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শেখ হাসিনার পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন খাতে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিলেও অভিবাসন খাতে তা কার্যকর হয়নি।

ভিসা ট্রেডিং, মেডিকেল টেস্ট, ভিসা অনুমোদন এবং বিভিন্ন দেশে অভিবাসী কর্মীদের বিমান ভাড়াসহ অভিবাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট এখনও সক্রিয় বলে জানা গেছে। অতিরিক্ত অভিবাসন খরচ মেটাতে অনেক অদক্ষ শ্রমিক এবং ইচ্ছুক অভিবাসনপ্রত্যাশী অবৈধ পথে বিদেশে যাচ্ছেন। অনেকে গন্তব্য দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। এইসব কারণে বাংলাদেশিদের জন্য অনেক সম্ভাব্য বাজার বন্ধ হয়ে গেছে।

সিরাজগঞ্জের অভিবাসনপ্রত্যাশী মো. সোহেল রানা বলেন, ‘গত দুই বছর ধরে ফ্যাক্টরি কর্মী হিসেবে সিঙ্গাপুরে যাওয়ার চেষ্টা করছি, কিন্তু অধিক অভিবাসন খরচের কারণে ব্যর্থ হচ্ছি। ১০ সেপ্টেম্বর মোট ৭ লাখ টাকার মধ্যে ৫ লাখ টাকা জমা দিয়েছি। অক্টোবরের মাঝামাঝি যাত্রার আগে বাকি টাকা পরিশোধ করতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে ও পরে অভিবাসন খাতে তিনি কোনো পরিবর্তন দেখতে পাননি। সিন্ডিকেট তাদের ইচ্ছেমতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।

অভিবাসন অধিকার কর্মীরা বলছেন, সিন্ডিকেটগুলো এখনও এই খাতে সক্রিয় এবং দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরেও অত্যাধিক অভিবাসন খরচের বিষয়ে কোনো পরিবর্তন হয়নি। ‘অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম’ -এর চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘আজও অভিবাসন খাতে কোনো পরিবর্তন দেখছি না।’

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘সকল এজেন্ট এবং সাব-এজেন্টকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে তারা কাজ করছেন। সরকার কোনো সিন্ডিকেটকে প্রশ্রয় দেবে না এবং অভিবাসন খরচ নিয়ন্ত্রণ করবে।’

তিনি মঙ্গলবার তার মন্ত্রণালয়ের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এ কথা জানান।

শাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘অত্যাধিক অভিবাসন খরচ বলপূর্বক শ্রমের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং মানি লন্ডারিংয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’

তিনি অত্যাধিক অভিবাসন খরচকে নৈতিক ও নিরাপদ অভিবাসনের অন্যতম প্রধান বাধা হিসেবে বর্ণনা করেন। বিদ্যমান ব্যবস্থা বন্ধ করার জন্য ‘কর্মীর খরচে অভিবাসন’ বা ‘শূন্য অভিবাসন খরচ নীতি’ চালু এবং সরকারের পক্ষ থেকে শক্তিশালী নজরদারি ব্যবস্থা চালু করার পরামর্শ দেন তিনি।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় শুধুমাত্র ১৭টি গন্তব্য দেশের জন্য অভিবাসন খরচ নির্ধারণ করেছে। তবে বাংলাদেশিরা বর্তমানে ১৫০টিরও বেশি দেশে অভিবাসিত হচ্ছে। কর্মীরা অভিযোগ করেন যে, তারা আত্মীয়স্বজন এবং স্থানীয় ঋণদাতাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে, জমি, গবাদি পশু এবং ফসল বিক্রি করে অত্যাধিক অভিবাসন খরচ সংগ্রহ করে থাকেন।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা)-এর সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী অত্যাধিক অভিবাসন খরচের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, সরকার নির্ধারিত হার খুব কমই মানা হয়। সরকার নির্ধারিত অভিবাসন খরচ অবাস্তব এবং অভিবাসন সংক্রান্ত অন্যান্য খরচ অনিয়ন্ত্রিত রয়ে গেছে।

তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘অভিবাসন খরচ বিমান ভাড়া, পাসপোর্ট খরচ এবং চিকিৎসা খরচসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। এই সকল খরচ অধিক এবং অনিয়ন্ত্রিত। এই সকল বিষয় মোট অভিবাসন খরচের ওপর প্রভাব ফেলে। আমাদের অভিবাসন ব্যবস্থা দীর্ঘ ও জটিল। প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ করতে তিন থেকে চার মাস সময় লাগে। ফলে খরচ বেড়ে যায়।’

তিনি বিমান ভাড়া, ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ এবং একটি বাস্তবসম্মত অভিবাসন খরচ নির্ধারণ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

বায়রার যুগ্ম-সম্পাদক টিপু সুলতান বলেন, ‘অভিবাসন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন পক্ষের সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু, শুধুমাত্র রিক্রুটিং এজেন্টদের দোষারোপ করা হয়। বাংলাদেশ থেকে বিমান ভাড়া কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই সবচেয়ে বেশি। যা অভিবাসন খরচ বাড়ায়।’

বর্তমানে, কাতার, কুয়েত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং রোমানিয়াতে জনশক্তি রিক্রুটিং এজেন্টদের সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তারা বলেন, অভিবাসন ব্যবস্থায় মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকাও অভিবাসন খরচ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ব্র্যাক অভিবাসন প্রোগ্রাম এবং ব্র্যাক ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশে অভিবাসন খরচ বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক হতে পারে। এর জন্য রিক্রুটার এবং সরকারি সংস্থা সমানভাবে দায়ী। সরকার বেশ কয়েকটি দেশের জন্য অভিবাসন খরচ নির্ধারণ করেছে কিন্তু তারা কখনও এর বাস্তবায়নের ব্যাপারে কোনো ধরনের আগ্রহ প্রকাশ করেনি। সরকার যদি সত্যিই খরচ নিয়ন্ত্রণ করতে ইচ্ছুক হয়, তবে তা সম্ভব।’

কর্মকর্তারা বলেন, মরিশাস এবং রোমানিয়াসহ বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিয়োগ বারবার স্থগিত করেছে কারণ সেখানে কর্মরত প্রবাসীরা ‘অভিবাসন খরচ’ উশুল করার জন্য বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি করার জন্য ভ্রমণ করে থাকেন।

২০২১ সালের মার্চ মাসে, মশিউর রহমান এবং তার মতো আরো অনেক যুবক ইউরোপীয় দেশ রোমানিয়াতে ১২ লাখ টাকা খরচ করে অভিবাসিত হন, কারণ সেই সময় সরকার সেই দেশের জন্য কোনো অভিবাসন খরচ নির্ধারণ করেনি।

তিনি বলেন, ‘তিনি সেখানে একটি প্যাকেজিং কারখানায় মাসিক ৩০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন। সেখানে তার দৈনন্দিন খরচ মেটানোর পর অভিবাসন খরচ উশুল করার জন্য এই টাকা খুবই অপ্রতুল ছিল। আমি আরও ভালো আয়ের জন্য সেপ্টেম্বর মাসে রোমানিয়া থেকে ইতালিতে চলে আসি।’

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষণ ও আবেদন অনুবিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, গত এক বছরে তারা কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি।

নিউ এজ অবলম্বনে

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.