অবশেষে স্বস্তি! শ্রমিকদের দাবি মেনে নিলেন মালিকপক্ষ

বিক্ষুব্ধ পোশাক শ্রমিকদের দীর্ঘ আন্দোলনের মুখে অবশেষে নতি স্বীকার করলেন পোশাক কারখানার মালিকপক্ষ। মঙ্গলবার এক বৈঠকে উপস্থিতি বোনাস, টিফিন ও রাত্রিকালীন ভাতা বৃদ্ধিসহ শ্রমিকদের প্রায় সব দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।

ছবি - সংগৃহীত

নতুন এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে – বকেয়া বেতন পরিশোধ, সর্বশেষ মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন, এবং সকল কারখানায় ন্যূনতম মজুরি প্রদান।

শ্রম মন্ত্রণালয়, মালিকপক্ষ এবং শ্রমিক নেতাদের যৌথ সভায় আন্দোলনরত শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবির ভিত্তিতে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয়।

সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া জানান, শ্রমিকদের সকল দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে।

তিনি জানান, মালিকপক্ষ এবং শ্রমিক নেতারা ১৮ দফা দাবি বাস্তবায়নের বিষয়ে লিখিতভাবে সম্মত হয়েছেন। এই সিদ্ধান্তগুলো তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করা হবে।

শ্রম উপদেষ্টা আশা প্রকাশ করেন, শ্রমিকদের দাবি মেনে নেওয়ায় বুধবার থেকেই শিল্পাঞ্চলে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে।

সংবাদ সম্মেলনে শ্রম সচিব এ এইচ এম শফিকুজ্জামান ঘোষণা দেন, উপস্থিতি বোনাস ২২৫ টাকা বৃদ্ধি এবং টিফিন ভাতা ১০ টাকা বাড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন মালিকপক্ষ। এছাড়াও, রাত্রিকালীন ভাতা ন্যূনতম ১০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

তিনি জানান, আগামী অক্টোবর মাসের মধ্যেই সকল কারখানায় নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন করা হবে এবং ১০ অক্টোবরের মধ্যে সকল বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হবে।

মালিকপক্ষ আরও সম্মত হয়েছেন যে, লিঙ্গ বৈষম্য ছাড়াই যোগ্যতার ভিত্তিতে নারী-পুরুষ সকলের জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হবে।

মালিকপক্ষ ও শ্রমিক নেতাদের মধ্যে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারকে বলা হয়েছে, শ্রম আইন লঙ্ঘন করে কোনো শ্রমিককে অযৌক্তিকভাবে চাকরিচ্যুত করা যাবে না এবং প্রসূতি ছুটি ১২০ দিন নিশ্চিত করতে হবে।

সমঝোতা স্মারকে আরও বলা হয়, প্রাথমিকভাবে সরকারি ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এবং খাদ্য মন্ত্রণালয় শ্রমঘন এলাকাগুলোতে সাশ্রয়ী মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করবে এবং শ্রমিকদের জন্য স্থায়ী রেশনিং ব্যবস্থা চালুর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাবনা পেশ করা হবে।

শ্রম আইন অনুসারে, মালিকপক্ষ সকল কারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপনের ব্যাপারেও সম্মত হয়েছেন।

ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণের বিষয়ে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছেন যে, শ্রম মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের তিনজন করে প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত একটি কমিটি ছয় মাসের মধ্যে মজুরি নীতিমালা এবং শিল্পের সক্ষমতা পর্যালোচনা করবে।

কমিটি আগামী নভেম্বর মাসের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনা করে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির বিষয়ে সুপারিশ করবে।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) বায়োমেট্রিক ডাটাবেসে শ্রমিকদের ব্ল্যাকলিস্ট করার বিষয়ে শ্রম মন্ত্রণালয়ের একটি কারিগরি কমিটি বিষয়টি পর্যালোচনা করে অক্টোবরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে।

উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, শিল্পাঞ্চলে যাতে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় তা নিশ্চিত করতে সকল পক্ষকেই গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকতে হবে।

তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ আলোচনার পর শ্রমিকদের দাবির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং আমরা বুধবার থেকে আর কোনো অস্থিরতা দেখতে চাই না।’

জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, বুধবার থেকে সকল কারখানা খুলে যাবে এবং অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ভবিষ্য তহবিল চালু করাসহ অন্যান্য দাবির বিষয়ে মালিকপক্ষ এবং শ্রমিক নেতারা সম্মত হন যে, কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফআই) শ্রমিক ও মালিক উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবে।

সমঝোতা স্মারকে আরও বলা হয় যে, ২০২৩ সালের মজুরি আন্দোলনসহ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সকল মামলা পর্যালোচনা করে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে।

এছাড়াও, মজুরি আন্দোলনের সময় নিহত চার শ্রমিকের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।

সমঝোতা ঘোষণার পর ইন্ডাস্ট্রিয়াল অল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) সাবেক সাধারণ সম্পাদক কুতুবুদ্দিন আহমেদ শ্রমিকদের বুধবার থেকে কাজে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান।

বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বুধবার থেকে কারখানা সুষ্ঠুভাবে চালু রাখার জন্য সরকারের কাছে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, আশুলিয়ায় অবস্থিত দেশের বৃহৎ বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানা শ্রম অস্থিরতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমরা বুধবার থেকে সুষ্ঠুভাবে কারখানা পরিচালনা করতে চাই এবং আর কোনো অস্থিরতা বা ভাঙচুর দেখতে চাই না।’

বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, মজুরি বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবিতে শ্রমিকদের বিক্ষোভের জের ধরে মঙ্গলবার সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরের ৩৯টি পোশাক কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়।

এই ৩৯টি কারখানার মধ্যে ৩৫টি সাভার ও আশুলিয়া অঞ্চলে এবং বাকি চারটি গাজীপুরে অবস্থিত।

শ্রম আইনের ১৩(১) ধারা অনুসারে ‘কোন কাজ নেই, কোন বেতন নেই’ এই বিধানের আওতায় আশুলিয়া এলাকায় মোট ২৯টি পোশাক কারখানা বন্ধ রাখা হয়।

অন্য ছয়টি কারখানা ছুটি ঘোষণা করেছে, কারণ শ্রমিকরা সকালে কাজে যোগ দেওয়ার পর কেউ কেউ চলে যান অথবা আর কাজে ফিরে আসেননি।

মজুরি বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবিতে আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে তৈরি পোশাক খাতে শ্রমিক অস্থিরতা শুরু হয় এবং তা এতদিন অব্যাহত ছিল।