পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আমদানি করা জ্বালানি তেলের পেছনে বাংলাদেশের খরচ বেড়েছে ২০ শতাংশ। বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে লাভবান করতে নীতিতে সুযোগ রাখায় এমনটিই ঘটেছে।

electricity 8বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) একটি অভ্যন্তরীণ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জ্বালানি তেল পরিবহনের খরচ নির্ধারণে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে, কিভাবে বেসরকারি কোম্পানিগুলো মুনাফার পাহাড় গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।

বেসরকারি কোম্পানিগুলো প্রায়শই জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য ভাড়া করা জাহাজের অর্ধেক ধারণক্ষমতা ব্যবহার করেছে, যাতে তাদের খরচ বেশি দেখিয়ে বেশি মুনাফা করা যায়। কারণ, খরচের ওপর ৯ শতাংশ সেবা চার্জ পেত তারা।

উল্লেখ্য, দেশের মোট ২৭,৭৯১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার মধ্যে ৫,৮৮৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। আর এই তেল আমদানি করে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকরাই।

২০২২-২৩ অর্থবছরে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও জ্বালানি তেল আমদানিতে বাংলাদেশের খরচ হয়েছে ৩৮,০০০ কোটি টাকারও বেশি। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হতে হয়েছে।

বিশ্লেষণের সঙ্গে জড়িত বিপিডিবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘জ্বালানি আমদানি নীতি সুশৃঙ্খল করার মাধ্যমে আমদানি খরচ কমপক্ষে ২০ শতাংশ কমানো যেত।’

বিশ্লেষণে ব্যবহৃত একটি নথিতে দেখা গেছে, ২৬৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার তিনটি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিক ‘বারাকা শিকলবাহা পাওয়ার লিমিটেড’ একবারে ১৫,০০০ টনেরও বেশি জ্বালানি তেল আমদানি করে। সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশে তেল পরিবহনের জন্য তারা ৩০,০০০ টন ধারণক্ষমতার একটি মাঝারি ট্যাঙ্কার ব্যবহার করে। অথচ তারা প্রতি টন তেলের পেছনে ৪৩ ডলারেরও বেশি ভাড়া গুনেছে।

বিপিডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি ঘন ঘন ব্যবহার করা হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের এক-চতুর্থাংশ এসেছে এসব কেন্দ্র থেকে। বারাকা তাদের তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য সমন্বিতভাবে তেল আমদানি করতে পারত। এতে করে জাহাজের পূর্ণ ধারণক্ষমতা ব্যবহার করে খরচ কমানো যেত।

বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে, যেসব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে, তারা ইন্দোনেশিয়া থেকে মাঝারি ট্যাঙ্কারে প্রতি টন কয়লা আমদানিতে ১৩-১৪ ডলার ভাড়া গুনেছে।

বিপিডিবির অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, কিছু তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অপারেটর প্রতি টন তেল আমদানিতে ৬০ ডলার পর্যন্ত খরচ দেখিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেল পরিবহনের খরচ কয়লার চেয়ে কম হওয়া উচিত। কারণ তেল পাইপলাইনের মাধ্যমে জাহাজে উঠানো এবং নামানো হয়, যা কয়লার তুলনায় অনেক সহজ।

‘জ্বালানি আমদানি এবং এর খুঁটিনাটি সম্পর্কে মানুষ খুব কমই জানে। বিগত দিনের জ্বালানি আমদানির বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করে দেখার দাবি জানাচ্ছি,’ বলছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন।

বিপিডিবির বিশ্লেষণে আরও উঠে এসেছে যে, বেসরকারি কোম্পানিগুলির সঙ্গে জড়িত কিছু অফশোর কোম্পানি আমদানি ব্যবসায় জড়িত ছিল, যা আমদানি খরচ ৭ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে।

বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের সঙ্গে সরকারের স্বাক্ষরিত চুক্তিতে তৃতীয় পক্ষকে আমদানিতে জড়িত করার সুযোগ ছিল।

সরাসরি জ্বালানি তেল আমদানি করলে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের ২৫ শতাংশ শুল্ক এবং মূল্য সংযোজন কর (মূসক) দিতে হতো। কিন্তু তৃতীয় পক্ষ জড়িত থাকায় ৫ শতাংশ অগ্রিম কর এবং ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর - এই অতিরিক্ত খরচের কারণে আমদানি খরচ ৭ শতাংশ বেড়ে যায়।

বিপিডিবির ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘তৃতীয় পক্ষ হিসেবে যেসব কোম্পানি ছিল, তার সবই বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের নিজস্ব অফশোর কোম্পানি।’

গত দেড় দশক ধরে জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি বিদ্যুৎ খাতের অন্যতম একটি ছিদ্র হিসেবে কাজ করছে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত খালি করছে।

ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিও বেশিরভাগই ছিল তেলভিত্তিক। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল একটি ক্ষতিপূরণ আইনের আওতায়, যার ফলে ক্ষতিকারক বিদ্যুৎ চুক্তির জন্য কারও বিরুদ্ধে দায় স্থাপন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

প্রাথমিকভাবে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলার একটি জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে ক্ষমতা চার্জের মতো ব্যয়বহুল ব্যবস্থা চালু করা হয়। এই ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র কতটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে তা বিবেচনা না করে কেবল তাদের ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে সরকারকে টাকা দিতে হয়।

তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকদের মধ্যে রয়েছে বিতর্কিত সমস্ত বিদ্যুৎ কোম্পানি, যাদের অসম বিদ্যুৎ চুক্তির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।

এই কোম্পানিগুলির মধ্যে রয়েছে সামিট গ্রুপ, ইউনাইটেড গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, শিকদার গ্রুপ, ডোরিন গ্রুপ এবং কনফিডেন্স গ্রুপ।

পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্য সচিব হাসান মেহেদী বলেন, ‘গত এক যুগ ধরে প্রতিটি বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানি জ্বালানি আমদানিতে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় দেখিয়েছে।’

‘বিপিডিবি এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বারবার সতর্ক করেছে, যাদেরকে পূর্ববর্তী সরকার লালন-পালন করেছে,’ তিনি আরও বলেন।

গত বছর বিপিডিবির লোকসানের পরিমাণ ছিল ৪৩,৫৩৯ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার ৩৯,৫৩৫ কোটি টাকা সাবসিডি প্রদান করেছে, যার একটি অংশ বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের সেবা চার্জ হিসেবে পরিশোধ করা হয়েছে।

কোম্পানি বিষয়ক এবং বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কার্যক্রম তদারকির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত বিপিডিবির কর্মকর্তারা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

নিউ এজ অবলম্বনে

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.