মঙ্গলবার দেশজুড়ে তীব্র বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিয়েছে। শহরাঞ্চলে একটানা পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৪৫ শতাংশ ব্যবহার করে গড়ে ১২,৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে।

electricity 8বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন

শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ ছিল। কারণ, ঐতিহ্যগতভাবেই বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় শহুরে গ্রাহকদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।

এই বিদ্যুৎ সংকট দেশের একমাস বয়সী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে বিপুল পরিমাণ বকেয়া বিল এবং নিম্নমানের বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে এই সংকট শিগগিরই কাটিয়ে উঠা সম্ভব বলে মনে হয় না।

উল্লেখ্য, শতভাগেরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও, গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে তীব্র বিদ্যুৎ সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ। শুধুমাত্র শীতকাল এবং প্রবল বৃষ্টির সময় বিদ্যুতের চাহিদা কমে যাওয়ায় এই সংকট সাময়িক স্বস্তি এনেছিল।

সম্প্রতি দিনের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এবং কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রে কারিগরি ত্রুটি এবং বকেয়া বিল পরিশোধ না করার কারণে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, এই সংকট আবারও তীব্র হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) বিদ্যুৎ উৎপাদনের দায়িত্বে থাকা সদস্য খন্দকার মোকাম্মেল হোসেন বলেন, ‘পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। কিন্তু এত সমস্যার মধ্যে সবকিছু ঠিক করে তোলা অনেক কঠিন।’

তিনি আরও জানান, গ্যাস সরবরাহে ঘাটতির কারণে বিপিডিবি ১,৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়েছে। ৯ সেপ্টেম্বর ১,৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ খাত পেয়েছে মাত্র ৮১৯ মিলিয়ন ঘনফুট।

মোকাম্মেল হোসেন বলেন, দেশের বৃহত্তম বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আদানি পাওয়ার (যার স্থাপিত ক্ষমতা ১,৫০০ মেগাওয়াট) তাদের বকেয়া বিল পরিশোধের জন্য বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে তাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ আরও ৫০০ মেগাওয়াট কমিয়ে দিয়েছে।

মঙ্গলবার ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি ৮০০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া বিল পরিশোধের জন্য প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।

এদিকে, বিপিডিবি'র মালিকানাধীন বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি সরবরাহকারী কয়লা খনিতে কারিগরি ত্রুটি দেখা দেওয়ায়, ৯ সেপ্টেম্বর থেকে এই কেন্দ্রটির কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ফলে জাতীয় গ্রিডে আরও ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে।

মোকাম্মেল বলেন, ‘আমরা আশা করছি শিগগিরই বরপুকুরিয়ায় কার্যক্রম পুনরায় শুরু করতে পারব।’ তবে তিনি কোনো সময়সীমা জানাতে পারেননি।

এছাড়া, ভারতের ত্রিপুরা থেকে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রপ্তানি অর্ধেকে নেমে এসেছে। অন্যদিকে, বকেয়া বিল পরিশোধ না করায় ভারত থেকে ভেড়ামারা হয়ে আসা বিদ্যুৎ সরবরাহ ১,১০০ মেগাওয়াট থেকে কমে ৯০০ মেগাওয়াটে নেমে এসেছে।

কয়লার ওপর নির্ভরশীল ৫০০ মেগাওয়াট বা তার বেশি ক্ষমতার বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো জ্বালানি ঘাটতি অথবা কারিগরি জটিলতার কারণে আংশিকভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছে।

উদাহরণস্বরূপ, ১,১৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র সোমবার সর্বোচ্চ ৮৫৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। পূর্ণ ক্ষমতায় কার্যক্রম চালাতে এই কেন্দ্রটির প্রতিদিন ১৩,০০০ টন কয়লার প্রয়োজন হলেও, জ্বালানি সরবরাহে ঘাটতির কারণে প্রতিদিন মাত্র ৮,০০০ টন কয়লা দিয়ে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে।

কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (মাতারবাড়ি কেন্দ্রের মালিক কোম্পানি) অন্তর্বর্তীকালীন প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেন মজুমদার বলেন, ‘আমাদের কাছে যে পরিমাণ কয়লা রয়েছে, তাতে আমরা আর সর্বোচ্চ দেড় মাস আংশিকভাবে কার্যক্রম চালাতে পারব।’

উল্লেখ্য, গত বছরের জুলাই মাসে কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে মাতারবাড়ি কেন্দ্র এখনও কোনো বিল পায়নি। এছাড়াও, দুর্নীতির অভিযোগে উচ্চ আদালতের আদেশে কয়লা আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় এই কেন্দ্রটি কয়লা আমদানিতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে।

সোমবার মধ্যরাত ১২টায় সর্বোচ্চ ২,৩১২ মেগাওয়াট লোডশেডিং রেকর্ড করা হয়েছে। এই সময়ে ১৫,৭০০ মেগাওয়াটের চাহিদার বিপরীতে বিপিডিবি ১৩,২৭৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছিল।

মঙ্গলবার শুধুমাত্র এই এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৩,০০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। এছাড়া সারাদিন গড়ে ১,৫০০ মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং হয়েছে।

সর্বোচ্চ লোডশেডিংয়ের সময় দেশের মোট ১২,০০০ মেগাওয়াটের বেশি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৬০ শতাংশই অব্যবহৃত ছিল। একই সময়ে প্রায় ৬,০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ও প্রায় ৪০ শতাংশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অব্যবহৃত ছিল।

গত মে মাসের শেষ দিকে ঘূর্ণিঝড় 'মোখা'র প্রভাবে দেশের দুটি ফ্লোটিং এলএনজি টার্মিনালের একটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর থেকেই গ্যাস সরবরাহ ঘাটতি তীব্র হয়ে উঠেছে।

ক্ষতিগ্রস্ত টার্মিনালটি চলতি সপ্তাহে পুনরায় কর্মক্ষম হওয়ার কথা থাকলেও, গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির কোনো নিশ্চয়তা নেই।

পেট্রোবাংলা মঙ্গলবার তাদের ১,১০০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ ক্ষমতার বিপরীতে মাত্র ৫৯০ মিলিয়ন ঘনফুট তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ করেছে।

পেট্রোবাংলার পরিচালক কামরুজ্জামান খান বলেন, ‘চলতি মাসের বাকি সময় জুড়েই গ্যাস সরবরাহ এই অবস্থায় থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ স্পট মার্কেট থেকে এখন গ্যাস আসছে না।’

এই মুহূর্তে বাংলাদেশ তীব্র বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর একটি প্রধান কারণ হলো বিদ্যুৎ খাতে বেপরোয়া ব্যয়।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছে।

রাজশাহীর বাঘমারা থানার বলানগর গ্রামের বাসিন্দা জিয়াউর রহমান বলেন, ‘গত দুই দিন ধরে আমরা প্রতিদিন প্রায় ১৯ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। বিদ্যুৎ আসার ১৫-২০ মিনিট পর আবার চলে যাচ্ছে। এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না।’

রাজশাহী শহরের মালদা কলোনী এলাকার বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘মঙ্গলবার সকাল প্রায় ৮টা ৩০ মিনিটে বিদ্যুৎ চলে যায়। দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে বিদ্যুৎ আসে। এত দীর্ঘক্ষণ বিদ্যুৎ না থাকার অভিজ্ঞতা আগে কখনও হয়নি।’

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) তথ্য মতে, সোমবার রাত ৯টায় ঢাকায় সর্বাধিক ৫২০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে।

নিউ এজ থেকে অনূদিত

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.